ভূমিকা
আফগান সাহিত্যের এক ব্যাপক অংশ সৃজিত হয়েছে দারি (ফার্সি ভাষার আফগান রূপ) ভাষায়। দারি কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত হয় ষাটের দশকের প্রথমার্ধে, পাশের দেশ ইরানের ফার্সি কবিতার বিবর্তনের প্রভাবে। ইরানে ‘ফ্রি স্টাইল পোয়েট্রি’ বা মুক্তক ঘরানাকে ধ্রুপদি কাব্য প্রকরণের দৃঢ় রীতি ভেঙে ভিন্ন এক ভাবনাপ্রধান কাব্যশৈলী নির্মাণের উদ্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যশস্বী ইরানি কবি নিমা ইউশিজ (১৮৯৭-১৯৬০) এই ধারার পথিকৃৎ। ফলে তাঁর নাম থেকেই মুক্তক কাব্যশৈলী ‘নিমায়ি’ কবিতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে ইরান ও আফগানিস্তানে। আফগানিস্তানেও নিমায়ি কাব্যশৈলী বলতে ধ্রুপদি কাব্যকলার বন্ধনমুক্ত হাল জমানার আধুনিক ভাবনাবিষয়ক কবিতাকে বোঝানো হয়। এখানে এই নিমায়ি রীতি বিকশিত হয় গত শতকের ষাটের দশকে। যুদ্ধজনিত কারণে সত্তর দশক থেকে প্রবাসের শরণার্থী শিবিরে বাস করে পরবর্তী জীবনে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হাওয়া আফগান কবিরা নিমায়ি শৈলীতে রচিত আধুনিক কাব্যধারাকে সমৃদ্ধ করতে শুরু করেন। তাঁদের রচনায় বিষয়রূপে আসে দিনযাপনের অনিশ্চয়তা, প্রণয়ের অন্তরঙ্গ অনুভূতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রতীকীভাবে রাজনৈতিক জীবনের হিউমার। এ ধারার নমুনা হিসেবে উপস্থাপিত হলো তিনটি দারি কবিতার অনুবাদ। ইংরেজি থেকে অনূদিত এই ত্রয়ী কবিতা এবং কবি পরিচিতির সূত্র হলো ওয়েবসাইট।
পারতাও নাদেরি
এখনো সময় আছে বাকি
এখন মাঝরাত
আমার উচিত মোনাজাতে রুজু হওয়া
কুয়াশার চাদরে ঢাকা প্রপাত
তাকাই আমার সততার আরশির দিকে
ধুলোর ধূসর প্রলেপে তা ছাওয়া।
জেগে ওঠা উচিত আমার
এখনো সময় আছে বাকি
বুঝতে পারি জলের সোরাহির সাথে পানপাত্রের ব্যবধান
নিবিড় কাকলিতে মাতে কটি রাজজাগা পাখি
কোলাহল থেকে বিযুক্ত হয় সংগীতের তান।
সময়ের রথচক্র ঘরঘরিয়ে নেমে যাচ্ছে বয়সের ঢালে
জানি না কখন এসে লাগবে ওপারের বাতাস আমার পালে।
আগামীকাল বিষাক্ত তিরে হয়তো বিদ্ধ হবে আমার দু-চোখ
দেখো চিত্রিত পাখি দুটি ডানা ঝাপটে উড়ালে হয়েছে উন্মুখ।
হয়তো আগামীকাল আমার সন্তান হবে বৃদ্ধ—প্রতীক্ষায়
আমার ঘরে ফেরার পথ চেয়ে সে বসে রবে—হায়।
পারতাও নাদেরি
জন্ম ১৯৫৩ সালে আফগানিস্তানের বাদাখশান প্রদেশে। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক। গত শতাব্দীর সাতের দশকের শুরুতে কবিতায় সোভিয়েতবিরোধী মতাদর্শের জন্য তিন বছর কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। আফগানিস্তানের আধুনিক কবিসম্প্রদায়ের পুরোধা এই কবি বর্তমানে আফগান পেন চাপ্টারের দায়িত্ব পালন করছেন।
রেজা মোহাম্মাদি
হাওয়া
যদি বা বাতাস পরে নেয় সুচারু পরিচ্ছদ
দু-পায়ে চামড়ার ফিতে আঁটা জুতা
রজনীর মধ্যযামে
আমার বাড়ির ভেতর দিয়ে বয়ে যেতে যেতে
একবাটি পেঁয়াজের সুরুয়া নিয়ে থামে।
সে চুমো খায় আমার মুখে
যখন আমি ইয়ারবক্সিদের সঙ্গে আড্ডায় মশগুল
রাজন্যকে বিদ্রূপ করে আবৃত্তি করি পদাবলি
রাজনীতির মাইফেলে আমি কবি এক উন্মূল।
সে আদতে অদৃশ্য তাই কেউ দেখতে পায় না তাকে
আমি তাকে অনুসরণ করি—হেঁটে যাই সরণির বাঁকে।
আমার দিনযাপনের পল্লবে হাওয়া বয় ঢের
অনেক বছর ধরে আমি প্রণয়কাতর বাতাসের।
রেজা মোহাম্মাদি
জন্ম ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানের কান্দাহারে। লন্ডনের মেট্রোপলিটান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর অর্জন করেছেন বিশ্বায়নের ওপর। ১৯৯৬-এ রেজা মোহাম্মাদি ইরানের ‘শ্রেষ্ঠ তরুণ কবি’ পদকে ভূষিত হন তিনি। পেশায় সাংবাদিক এই কবি সাংস্কৃতিক ভাষ্যকার হিসেবেও পরিচিত।
শাকিলা আজিজজাদা
অভিসার
হয়ে তো গেল অনেক বছর
তারপর ঝরেছে চেনারের পত্রালি ঢের
বলতে পারি না ‘শুভকামনা’ দেখা হবে ফের
যেহেতু আমরা ক্রমাগত হচ্ছি প্রবীণ
আমাদের দেখা হবে নিশ্চিত
কেবলমাত্র রোজ কেয়ামতের দিন।
আমি জানি তোমার উপস্থিতিতে
প্রফুল্ল হবে আমার তনুমন
তুমি বলতে রেশমের কৃষ্ণাভ টাইটস দুটি
আমার দু-পায়ে দেখাত সুদর্শন।
যদি একবার আমি দেখতে পেতাম
তোমার চাহনি শরমে শিহরিত
কম্পমান চোখজোড়া আমার
ফিতার ফুল ছুঁয়ে হচ্ছে উদ্দীপ্ত।
ধরবে বাজি—আমি বলি নদী
নাকি তুমি চাও মাছ
বয়ে যায় আমাদের প্রেষণার জলধি।
তোমার সাথে দেখা হবে ফের প্রস্রবণের পাশে
তোমার হাতে থাকবে একটি গোলাপ সংগোপনে
স্বপ্ন আমার ভাঙচুর হবে মৌমাছির গুঞ্জরণে
আর প্রত্যাশায় আমি হব থর থর আনত
পুষ্পের ভারে ডালিমের ডালটির মতো।
শাকিলা আজিজজাদা
জন্ম ১৯৬৪ সালে আফগানিস্তানের কাবুলে। বর্তমানে প্রবাসী এই কবি নেদারল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ব্যক্তিগত বাসনার অন্তরঙ্গ স্বর প্রতিভাত হয় তাঁর কবিতায়। কবিতা ছাড়াও তিনি রচনা করেছেন নাটক। মঞ্চে কবিতার উপস্থাপনায় তাঁর দক্ষতাও প্রসংশিত হয়েছে।