দেহের বহিরঙ্গ দৃষ্টিগোচর হলেও শরীরের ভেতরের জৈবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমরা কি দেখতে পারি? আর মন তো একেবারে রূপরেখাহীন। অথচ এই দুই মিলেই আমাদের অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয়। দেহ ও মনকে ঘিরে যে আত্মার বিচরণ, এবারের প্রদর্শনীতে ওয়াকিলুর রহমানও খুঁজেছেন তাকে। খুঁজেছেন নিজেকেই। হ্যাঁ, তিন দশক আগে ত্রিশের ভরা যৌবনে জার্মান প্রবাসকালে শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানও খুঁজেছিলেন নিজেকে। কীভাবে, কোন ভাবনায় এবং কেমন করে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন নিজেকে তা দেখতে চাইলে যেতে হবে দ্বীপ গ্যালারিতে। ‘দেহ জমি। মনোভূমি’ শিরোনামের প্রদর্শনীতে।
প্রবাস জীবনের একাকিত্ব, অনিশ্চয়তা, জৈবিক চাহিদা ও অনভ্যস্ত সাংস্কৃতিক পরিবেশ যাপনের ফলে সে সময় শিল্পী ছিলেন নিজের অস্তিত্ব সন্ধানে মগ্ন। পাশাপাশি এ সময় প্রাচ্যভাবনাও আচ্ছন্ন করেছিল তাঁর হৃদয়। তাই তাঁর এই কাজগুলোতে পট, সরা, তান্ত্রিক শিল্পের ভাষা, মিনিয়েচার পেইন্টিংয়ের রূপ-রস, ভারতীয় চিত্রকলার ছায়া, বুদ্ধ ও লালনের দর্শন, বাংলার নদী-মাটি-জলের সরল ফর্ম, দেহতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্ব—এসব কিছুর উপস্থাপন দেখতে পাই ক্ষুদ্র আয়তনে এ্যগ টেম্পারায়। এই এ্যগ টেম্পারা দীক্ষা তিনি পেয়েছিলেন শিল্পী শহীদ কবিরের কাছে।
এখানে মানুষের দেহজমির অন্তর্কথন তিনি যেমন বিন্যাস করেছেন, তেমনি নানান প্রতীকের বিন্যাসের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন মনোজাগতিক বিস্তৃতি। ভাঙা পাঁজর, ভাঙা নৌকা, প্রতীকী প্রাণ পাখি, আত্মমগ্ন বাউলের দেহভঙ্গিমা—পুরো চিত্রজমিন যেন বাউল ও ভাটিয়ালির সুর দিয়ে বাঁধা।
কতক ছবি গণেশ পাইনের চিত্রের মতো মনে হলেও অধিকাংশ কাজেই রয়েছে স্বকীয়তা ও ভিন্নতা। অর্থাৎ গণেশ পাইনের কাজের সঙ্গে ওয়াকিলের কাজের স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। রং ব্যবহারে অতি নাটকীয়তা বিবর্জিত হলেও গোধূলির আভার স্নিগ্ধ আলো-আঁধারি রং প্রাচ্য মনস্তত্ত্বের নাটকীয়তাকে যেন পষ্ট করেছে।
কৃষিপ্রধান বাংলা তথা ভারতবর্ষের মানুষের গৃহের স্থাপত্য, অধ্যাত্মসাধনা, সকাম ও নিষ্কাম ভাব, প্রেম—এগুলো বুঝে নেওয়া যায় চিত্র উপাদানের সূত্র ধরে। যেমন, ‘দেহজমি । মনোভূমি–৮’ ছবিতে মাটির ঘর, বারান্দামধ্যস্থ যোগাসনে ভাবুক ফিগার; ‘দেহজমি । মনোভূমি–৬’–এ আদিরসে মত্ত যুগল ফিগার নিশ্চয়ই দেহতত্ত্ব মনস্তত্ত্বের ন্যারেটিভ গল্পকেই ইঙ্গিত করে। তদুপরি এ অঞ্চলের মানুষের দুঃখ, আলস্য, ভাবুকতা, রহস্যময়তা, সংসার বন্ধন এবং সংসার বন্ধনহীন সন্ন্যাসব্রত পালনের সহজ পাঠ নেওয়া যেতে পারে ওয়াকিলুর রহমানের চিত্রগুলো থেকে।
যৌবনের প্রথম ভাগে ওয়াকিল ইউরোপের মাটিতে তাঁর শিল্পকর্মে যে ঐতিহ্যের সন্ধান, আত্ম আবিষ্কারে লালন এবং বাউল দর্শনের চিত্রভাষ্য তৈরি করেছিলেন, তা আমাদের পরম্পরা শিল্পভাষারই সহোদর। পরে তাঁর ভাবনায় অনেক বাঁক–বাঁকান্তর এসেছে; নিজের বক্তব্য নির্মাণে অনিশ্চয়তা যত কমেছে, এসেছে দৃঢ়তা; তারপরও তাঁর এই চিত্রভাষা সমসাময়িক সময় এতটুকু ফিকে হয়নি—কথাটি দৃঢ়ভাবেই বলা যাবে। প্রদর্শনীটি চলবে ৩১ মে পর্যন্ত।