অপ্রকাশিত

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি চিঠি

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩—৪ জানুয়ারি ১৯৯৭)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩—৪ জানুয়ারি ১৯৯৭)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

তাঁর বিছানার পাশে শুধু এক পাটি স্যান্ডেল, আরেক পাটি স্যান্ডেলের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, কারণ তাঁর আরেকটি পা নেই। ক্যানসারে আক্রান্ত পা’টি কেটে ফেলার পর হাসপাতালের বিছানার পাশে ওই এক পাটি স্যান্ডেলের বিষণ্নতার প্রেক্ষাপটে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর শরীরের এক্স-রে প্লেটটা আলোর উল্টো দিকে ধরে আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘বাঁচব তো?’ আমার ডাক্তারি বিদ্যার ওপর ভরসা করতে চেয়েছিলেন তিনি। একটা গাঢ়, ভারী পর্দার মতো নীরবতা নেমেছিল আমাদের দুজনের ভেতর। সেই কবেকার কথা! বছর দশ পেরিয়ে গেছে। সবল দুই পায়ে কিংবা ক্রাচে ভর করে কোনোভাবেই ইলিয়াস ভাই আর পৃথিবীর পথে হাঁটেন না। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় গত শতকের আশির দশকের শেষের দিকে। ডাক্তারি পড়তে এসে সাহিত্যের এক পাগলা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে দিগ্ভ্রান্ত আমি তখন, ‘পাগলা ঘোড়া রে কই মানুষ কই লইয়া যাও’। সে সময় ইলিয়াস ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় আমার জন্য ‘দারুচিনি দ্বীপ’। ছুটে গেছি তাঁর টিকাটুলীর বাড়িতে, ঢাকা কলেজ, মিউজিক কলেজের অফিসে, ঘুরেছি পাশাপাশি সিটে ঢাকার লোকাল বাসে। জীবন, সাহিত্য, রাজনীতির ঘোলা পৃথিবীর অস্পষ্টতা খোলাসা করার আকুতি নিয়ে আড্ডা দিয়েছি তাঁর সঙ্গে। পাইপে তামাক ভরতে ভরতে তাঁর আদিম, নিষ্কলুষ চিহ্নমাখা সেই অট্টহাসির ভেতর ডুব দেওয়া সেসব আড্ডা বহুদিন আগে দেখা এক স্বপ্নের মতো মনে হয়। গভীর উদারতায় এক অগ্রজ লেখক হিসেবে অবারিত প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি আমাকে, আমার সাহিত্য-উৎসাহের পালে হাওয়া দিয়েছেন। ডাক্তারি পাস করে চলে গিয়েছিলাম উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গ্রাম স্বাস্থ্য প্রকল্পের চিকিৎসক হিসেবে দেশের নানা মফস্বল অঞ্চলে। শুরু হয়েছিল ইলিয়াস ভাইয়ের সঙ্গে চিঠির যোগাযোগ। আমি চিঠি প্রজন্মের মানুষ, দরজার নিচে এক টুকরো রোদের মতো পড়ে থাকা খাম দেখে উছলে উঠত মন। ইলিয়াস ভাইয়ের তেমন চৌকো রোদ তখন ঢাকা থেকে দূরের আমার মফস্বল ঠিকানায় এসে পৌঁছাত। লেখার মতো চিঠিও ইলিয়াস ভাই লিখতেন টাইপরাইটারে। শুধু চিঠির নিচে নিজ হাতে নিজের নামটা স্বাক্ষর করতেন। দেশ-বিদেশে ঘর বদল করতে করতে সেসব চিঠি হারিয়েছি। সেদিন পুরোনো কাগজের ভিড়ে খুঁজে পেলাম আমাকে লেখা এই চিঠি।

সেটা ১৯৯১ সাল। আমি তখন গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ এলাকার স্বাস্থ্য প্রকল্পে ডাক্তার হিসেবে কাজ করছি। ইলিয়াস ভাই তখন তাঁর খোয়াবনামা বইটা লিখছেন। তাঁর বইটির প্রেক্ষাপট গোবিন্দগঞ্জের ঘোড়াঘাট এলাকা। এ সময় বেশ কয়বার তিনি আমার ওখানে এসেছেন। ব্র্যাকের ডাক্তার হিসেবে আমার জন্য একটা মোটরসাইকেল বরাদ্দ ছিল। ইলিয়াস ভাইকে মোটরসাইকেলের পেছনে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি ঘোড়াঘাট, নাকাইহাট অঞ্চলে। সঙ্গী হয়েছি এই অঞ্চলকে আবিষ্কারে তাঁর অভিযানে।

এই চিঠিটি যখন লিখছেন তার কিছু আগে আমি তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, যাকে এই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘ম্যারাথন ইন্টারভিউ’ হিসেবে। সেই সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত লিরিক পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায়। পরবর্তীকালে নানা জায়গায় সাক্ষাৎকারটি পুনর্মুদ্রিত হয় এবং আমি সাক্ষাৎকারটিকে আমার কথাপরস্পরাবইয়ে সংকলিত করি। সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে কথা হচ্ছিল আমাদের জনসংস্কৃতি, মধ্যবিত্ত লেখকদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ইত্যাদি নিয়ে। কথা হয়েছিল তাঁর ঢাকার বাসায়। আমি গোবিন্দগঞ্জ ফিরে গেলে তিনি এই নিয়ে তাঁর ভাবনাকে আরেকটু খোলাসা করতে এই চিঠিটি লিখেছিলেন। এই বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা তো ফুরানোর নয় কখনো, তাই চিঠিটি ছাপার কথা ভাবলাম। চিঠির ভেতর তাঁর ভাবনা, ব্যক্তিত্বও ফুটে আছে স্পষ্টত। সিরিয়াস আলোচনার ফাঁকে টুকরো কৌতুক জুড়ে দেওয়া ছিল তাঁর আড্ডার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেই চিহ্ন আছে এই চিঠিতেও। আমার একান্ত ঘরোয়া ডাকনাম ‘মুন্না’, ইলিয়াস ভাই সে নামেই ডাকতেন আমাকে, চিঠিতে সেই নামেই সম্বোধন করেছেন।

অহং, আত্মশ্লাঘা, ঈর্ষা, প্রতিযোগিতার নখ, থাবা এড়িয়ে আলতো করে জীবনযাপন করা এখন কঠিন। ইলিয়াস ভাইয়ের চিঠিটা পড়তে পড়তে মনে পড়ছিল সেই সব সময়ে কী এক নিরাপদ ওমের ভেতর তাঁর সঙ্গে বসে মন খুলে কথা বলতে পারতাম জগৎ সংসারের তুচ্ছ-বৃহৎ সব রকম বিষয় নিয়ে। সেসব দিন বুঝি বাসি এখন।

২৪ অক্টোবর ১৯৯১     ১২/৩ কে এম দাশ লেন

টিকাটুলি, ঢাকা ১২০৩

প্রিয় মুন্না,

৬ তারিখ থেকে আমার রক্ত আমাশার প্রকোপ খুব বেড়ে গিয়েছিল, ঝাড়া ১০ দিন ভুগে উঠতে না উঠতে পড়লাম জ্বরে। কয়েক দিন হলো সুস্থ হয়েছি। তবে আরেকটা ঝামেলায় পড়েছি। তোমাকে লিখতে বেশ দেরিই হয়ে গেল।

সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের সেদিনকার আলাপটা এভাবে লিখলে কেমন হয়?

দেশবাসীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের সংস্কৃতিই হলো দেশের উন্নত সংস্কৃতির ভিত্তি। আমাদের মতো গরিব দেশে তো বটেই, উন্নত পশ্চিমেও সংস্কৃতির সামগ্রিক পরিচয় পেতে হলে অনুসন্ধান চালাতে হয় ওদের লোকজীবনের ভেতর। এখন যে তর্কটা সেদিন উঠেছিল তা হলো এই যে, শিল্পসাহিত্যের চর্চা যারা করে তারা মোটামুটি সবাই শহরের মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত ঘর থেকে এসেছে। তাদের পক্ষে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর সংস্কৃতি কতটা জানা সম্ভব, এবং এর আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি না।

আমার মতে এটা জানা খুবই দরকার। শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতি পরস্পরের সঙ্গে জড়িত হলেও এই দুটি কিন্তু অবিচ্ছিন্ন নয়, সংস্কৃতি কোনো একজন মানুষের নির্মিত নয়, হাজার হাজার বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের জীবনযাপন, অভ্যাস, প্রথা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, আশা, বেদনা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গে সংস্কৃতি বিকশিত হয়, বিবর্তিত হয়, বিকৃতও হতে পারে। এর বিকাশ, বিবর্তন বা বিকৃতি বলা যায় মানুষের ইচ্ছা–নিরপেক্ষভাবেই ঘটে থাকে, তবে প্রকৃতির মতো ইতিহাস, রাজনীতি ও উঁচু মানের শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলে। আর সাহিত্যসৃষ্টি একজন মানুষের সৃষ্টিশীল ও সচেতন প্রয়াসের ফল। এখন মানুষের গভীর ভেতরটার খানাতল্লাসি করেন বলে লেখককে জানতে হয় তার আগাপাছতলা। এখানে তার সংস্কৃতির যথাযথ পরিচয়টি সমন্ধে লেখক উদাসীন হলে মানুষকে তিনি চিনবেন কি করে? এই মানুষ মধ্যবিত্ত হোক আর উচ্চবিত্ত হোক তার সংস্কৃতির উৎস রয়ে গেছে দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাপনের ভেতর। যেকোনো লেখকই নিজের মাতৃভাষার অমিত সম্ভাবনাকে দেখতে পান নতুন করে, তাই তাঁর চিন্তা ও প্রক্রিয়াকে প্রকাশ করার মাধ্যম হিসাবে [হিসেবে] এটিকেই বেছে নেন। ভাষার মতো সংস্কৃতিকেও তিনি ব্যবহার করেন, পূর্ববর্তী বড় লেখকের তৈরি ভাষার ওপর এক শ ভাগ নির্ভর করলে নিজের কথা তিনি জীবনেও বলতে পারবেন না, সমসাময়িক ভাষার ওপর ভিত্তি করেই তিনি নিজের প্রকাশের উপযোগী ভাষা নির্মাণ করে নেন। একই সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতিকেও গুরুত্ব দেন, কারণ এ ছাড়া মানুষকে লেখায় নিয়ে আসা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। এই সংস্কৃতির শেকড় লোকজীবনের ভেতর প্রোথিত বলে সেখানে তাঁকে আগ্রহী হতেই হয়।

তুমি বলছিলে যে, গ্রামের নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর সংস্কৃতি তো আর আগের অবস্থায় নেই। সেখানে নিত্য পরিবর্তন ঘটছে, লেখক তাহলে তার সংস্কৃতির কী পরিচয় সেখান থেকে লাভ করবেন? কিন্তু তাতে কী এসে যায়? গ্রামে লোকসংগীতের চর্চা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে, জীবনযাপনের বদলের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের শ্রমজীবীদের সংস্কৃতিও অন্যভাবে বিবর্তিত হতে পারে। এটাকে বিবর্তনও বলতে পারো, বিকৃতি বলেও মন খারাপ করতে পারো। বলা যায়, গ্রামে দীর্ঘদিনের সংস্কৃতিচর্চা দারুণ সংকটাপন্ন। তাতে লোকজীবনের সংস্কৃতির দিকে লেখকের নজর দেওয়াটা বাড়ে বই কমে না। এই পরিবর্তন বা বিকৃতি বা সংকটের পরিচয়টি পেতে হলেও তার সংস্কৃতির বিশদ ব্যবচ্ছেদ দরকার, নইলে কেবল নিম্নবিত্তের জীবন নয়, মধ্যবিত্তের সংকট, এমনকি উচ্চ-মধ্যবিত্ত কোনো ব্যক্তির নিঃসঙ্গতাকেও প্রকাশ করা অসম্ভব। রাষ্ট্র, সমাজ ও দেশের বড়-ছোট যেকোনো সংকট সংস্কৃতিতে ছায়া ফেলে। লোকসংস্কৃতি এতে নতুন মাত্রা পায়, না উদ্ভট উপাদান ধারণ করে তা বোঝার জন্যেই শিল্পীকে [শিল্পীর] ওইদিকে আরও বেশি নজর দেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

ওই কথাগুলি তুমি একটু সাজিয়ে এবং গোটা লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করে লিখে দিয়ো। আচ্ছা, ওই ম্যারাথন ইন্টারভিউ ক্যাসেটে শুনে কি মনে হচ্ছে? ওটা কি পাতে দেওয়া যাবে শেষ পর্যন্ত? তোমার লেখা কি শেষ হয়েছে? হলে আমাকে একটু পাঠিয়ে দিয়ো। আর খুব ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ব্যাপারগুলো যা বলা হয়েছে তার শতকরা ৮০ ভাগই বাদ দিয়ো।

ঘোড়াঘাট গিয়েছিলে নাকি? ওদিকে এখন অভাব তো খুব প্রকট, তোমাদের তৎপরতা নিশ্চয় অনেক বেড়েছে। ওই এলাকার দুর্ভিক্ষের অবস্থাটা একটু জানাবে। দুর্ভিক্ষের কথা যেভাবে জানতে চাইলাম তাতে বঙ্কিমচন্দ্রের মুচিরাম গুড়ের কথা মনে পড়ল। এক ইংরেজ রাজকর্মচারী গ্রামে এসে এক চাষিকে জিজ্ঞেস করল, ‘ডুর্বিক্কা কেমন আছে? অল্প আছে কি অঢিক আছে?’ লেখাটা মনে আছে? তা দুর্ভিক্ষ সমন্ধে আমার প্রশ্ন শুনেও কি তোমার তাই মনে হচ্ছে?

কেমন আছ? এর মধ্যে ঢাকায় আসবে? আমি এখন ভালো, তবে পেশাগত কাজের চাপ হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। চিঠি দিয়ো, তাড়াতাড়ি লিখবে। ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা নিয়ো। ইতি।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

২৪.১০. ১৯৯১