১৯৬৩ সালে গড়ে ওঠে স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড দল ‘আইওলাইটস’। কেমন ছিল সংগীতকে ঘিরে তাদের পথচলা? বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের শুরুর পর্বের ইতিহাস।
১৯৬৩ সালের ২২ মার্চ দুনিয়া কাঁপানো ব্যান্ড ‘দ্য বিটলস’-এর প্রথম স্টুডিও অ্যালবাম ‘প্লিজ প্লিজ মি’ যুক্তরাজ্যে প্রকাশিত হওয়ার চার দিন আগে ঢাকায় ফজলে রব নামের সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের এক বালকের মনে নতুন এক স্বপ্নের জন্ম নেয়। রবের স্বপ্নটা ছিল গিটার শেখার, দল বেঁধে গান করার। তাঁর মনে এই স্বপ্নের জন্ম নিয়েছিল ১৮ মার্চ স্কুলের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া টেলফার জনসন নামের এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছাত্রের গিটারজাদুতে মুগ্ধ হয়ে। তখনকার সময়ে আমাদের এই উপমহাদেশে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছেলেরাই গিটার বাজিয়ে পাশ্চাত্য সংগীতের নতুন ধারার গানগুলো গাইত। সেদিন গিটার বাজিয়ে টেলফার গাচ্ছিলেন বিটলসপূর্ব সময়ের ব্যান্ডসংগীতে শাসন করা ‘দ্য শ্যাডো’-এর জনপ্রিয় আর্টিস্ট ক্লিফ রিচার্ডের একটি জনপ্রিয় গান।
ফজলে রবের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল ৩০০ টাকা দিয়ে কেনা একটা ইলেকট্রিক গিটার আর একটা অ্যাম্প। এবারে দল বেঁধে গাওয়ার পালা। তার পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৬৪ সালে রবের সঙ্গে জুটে গেল রফিক মাযহার ইসলাম সাজু নামের স্কুলপড়ুয়া আরেক স্বপ্নবাজ গিটারবাদক। এরপর সুফি রশিদ নামের আরেকজন তাঁদের সঙ্গী হলেন, তখনো কিন্তু তাঁরা ব্যান্ড গঠন করতে পারেননি।
এই বাস্তবতায় এই তিনজন মিলে স্কুল-কলেজ-পাড়া–মহল্লায় গান গাইতে শুরু করলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সুফি এই সঙ্গ ত্যাগ করলে রফিক রিদম গিটার বাজানো শুরু করেন। এর মধ্যে ঢাকার নবাববাড়ির ছেলে খাজা সাব্বির কাদের ড্রামসেট নিয়ে যোগ দিলেন এই দলে। এবারে তাঁরা গঠন করলেন ব্যান্ড। নাম দিলেন ‘আইওলাইটস’ (Iolites)।
তিনজন মিলে তো দল পাকালেন, কিন্তু ভোকালিস্ট কই! তখন জুনিয়র এক ছেলেকে খুঁজে বের করলেন তাঁরা—নাম আলমগীর হক। এই আলমগীর হকের পরিচয়টা জানলে অনেকেই হয়তো এখন চমকে উঠবেন। বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীত আলমগীরের পরিবারের কাছে একধরনের ঋণী। আলমগীরের ছোট ভাই নয়ন মুন্সীকে বাংলাদেশের অন্যতম গিটারিস্ট বলা হয়, যিনি আজম খানের সঙ্গে গিটার বাজাতেন। আরেক ভাই দস্তগীর ছিলেন স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড ‘আন্ডারগ্রাউন্ড পিস লাভার’-এর ভোকালিস্ট ও ড্রামার। তাঁদের বোনের নাম জর্জিনা হক, যিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামার। এ ছাড়া আলমগীরের তিন বোন ‘ত্রি হক সিস্টার্স’ নাম দিয়েও কিছুদিন গানবাজনা করেছেন। অনেকের মনে হতে পারে, এতে চমকে যাওয়ার মতো কী আছে! এবার শুনুন, এই সেই আলমগীর হক, যিনি আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় গায়কদের একজন। উর্দু পপস্টার আলমগীরকে অনেকে প্রাচ্যের ‘এলভিস প্রিসলি’ বলে থাকেন। কোক স্টুডিওতে তাঁর গাওয়া বাংলা-উর্দুর মিশেলে ‘আমায় ভাসাইলি রে’ গানটা হয়তো অনেকেই শুনেছেন। তিনি একাধিকবার বাংলাদেশে গাইতেও এসেছেন।
আলমগীর হক ১৯৬৪–৬৭ সাল পর্যন্ত এই ব্যান্ডে ছিলেন। এরপর বড় গায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে করাচি চলে যান। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে আমেরিকায় গিয়েও সেই স্বপ্নের টানে পুনরায় করাচি ফিরে আসেন তিনি। আইওলাইটসে থাকার সময় আলমগীর হারমোনিকাও বাজাতেন। আলমগীর আইওলাইটস ছেড়ে চলে গেলে ফাহমি বেজ গিটারিস্ট হিসেবে ব্যান্ডে যোগ দেন। এ সময় ফাহমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর ভাই রফি ওমরকে। রফি ছিলেন আইওলাইটসের ম্যানেজার।
১৯৬৫ সালের শুরুর দিক থেকেই আইওলাইটস হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়মিত পারফর্ম করতে শুরু করে। তখন প্রতিটি বড় বড় হোটেলেই গানবাজনার ব্যবস্থা ছিল, যদিও কোথাও বাংলা গান গাওয়া হতো না। বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের শুরুর দিকে এই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ছিল সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। এই হোটেলের ছোট ডায়াসে গানবাজনা হতো, যেটা ‘চাম্বেলি রুম’ নামে পরিচিত ছিল। এই চাম্বেলি রুম ব্যান্ডসংগীত বিস্তারের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
ইন্টারকন্টিনেন্টালে শো করার আগেও আইওলাইটস শাহবাগ হোটেল (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল) ও ঢাকা ক্লাবে শো করত। ১৯৬৪ সালে বিটিভির সম্প্রচার শুরু হওয়ার পরের বছরেই তারা টিভিতে ৩০ মিনিটের একটা অনুষ্ঠানে ইনস্ট্রুমেন্টাল পরিবেশন করেছিল। এরপর হাদী নামের এক প্রযোজকের হাত ধরে এই ব্যান্ডের পারফরমেন্সের মাধ্যমেই এ দেশের টিভি চ্যানেলে প্রথমবারের মতো ‘ব্যান্ড শো’র সম্প্রচার শুরু হয়।
১৯৬৭ সালে বর্তমান ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশে প্রথম টিকিটের বিনিময়ে কনসার্টের আয়োজন করেছিল আইওলাইটস। কনসার্টের ব্যাপ্তিকাল ছিল ঘণ্টা তিনেক। সেই বছরেই ব্যান্ডের নাম পাল্টে রাখা হয়েছিল ‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’। জানা যায়, ব্যান্ডের নতুন নামের আইডিয়া তাঁরা পেয়েছিলেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘টুয়েলভথ নাইট’ থেকে।
ষাটের দশকে ‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার (আইওলাইটস)’ ছিল তরুণদের ক্রেজ। একবার ঢাকা ক্লাবে তাঁরা সন্ধ্যা সাতটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত কয়েকটা বিরতিতে জ্যামিং করেছিলেন। দর্শকেরা সারা রাত তাঁদের ছেড়ে যায়নি। শ্রীমঙ্গলের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তাঁরা তখন কনসার্ট করে বেড়িয়েছেন, এ জন্য পরিবারের বকুনিও খেয়েছেন। আইওলাইটস বা উইন্ডি সাইড অব কেয়ারের সদস্যরা সে সময় এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে ৬৭ সাল পর্যন্ত তাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২৭ হাজার টাকা জমা হয়েছিল। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রতি শোতে তাঁরা পেতেন ৭৫০ টাকা। প্রবেশমূল্য ছিল পাঁচ টাকা। ইন্টারকনে তাঁরা শেষ দফায় পারফর্ম করেছিলেন ১৯৬৯ সালে। তখন আইওলাইটস শুধু ‘ক্লিফ রিচার্ড’, ‘টম জনসন’, ‘দ্য বিটলস’, ‘দ্য এনিমেলস’সহ সে সময়ের জনপ্রিয় গানগুলো বাজাত। এসব আর্টিস্ট/ব্যান্ডই ছিল আইওলাইটসের অনুপ্রেরণা।
ইন্টারকন্টিনেন্টালে শো করার আগেও আইওলাইটস শাহবাগ হোটেল (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল) ও ঢাকা ক্লাবে শো করত। ১৯৬৪ সালে বিটিভির সম্প্রচার শুরু হওয়ার পরের বছরেই তারা টিভিতে ৩০ মিনিটের একটা অনুষ্ঠানে ইনস্ট্রুমেন্টাল পরিবেশন করেছিল। এরপর হাদী নামের এক প্রযোজকের হাত ধরে এই ব্যান্ডের পারফরমেন্সের মাধ্যমেই এ দেশের টিভি চ্যানেলে প্রথমবারের মতো ‘ব্যান্ড শো’র সম্প্রচার শুরু হয়।
১৯৬৮ সালে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সেই চাম্বেলি রুমে ‘সেরা ব্যান্ড’ নির্বাচনের জন্য প্রতিযোগিতা হয়েছিল, যেখানে উইন্ডি সাইড অব কেয়ার ছাড়াও র্যাম্বলিং স্টোন, লাইটনিংস ও ইনসেটস ডিউ নামে মার্কিন মুল্লুকের এক ব্যান্ডসহ আরও কয়েকটি ব্যান্ড নাম লিখিয়েছিল। প্রতিযোগিতায় সবাইকে হারিয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যান্ডের খেতাব জিতেছিল উইন্ডি সাইড অব কেয়ার। আর ব্যান্ডের ড্রামার সাব্বির নির্বাচিত হয়েছিলেন ‘শ্রেষ্ঠ মিউজিশিয়ান’ হিসেবে। তখন ইএমআই রেকর্ড কোম্পানি তাদের অ্যালবাম বের করার প্রস্তাব দিয়েছিল, উইন্ডি সাইড অব কেয়ার এই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণও করেছিল। ফলে ফোর্টি ফাইভ আরপিএমে বের হয়েছিল তাদের একটা অ্যালবাম, যেটা ছিল বাংলাদেশের কোনো ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবামও বটে।
একটানা ১৫ দিন ধরে করাচিতে অ্যালবামের জন্য তিনটি ইনস্ট্রুমেন্টাল রেকর্ড হয়েছিল। সেই সময় করাচির বেশ কয়েকটি পত্রিকা তাঁদের সাক্ষাৎকার ছাপিয়েছিল, টিভিতে একটা প্রোগ্রামও হয়েছিল। তাঁরা মূলত পশ্চিমা মিউজিকের সঙ্গে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশীয় সংগীতের মিশ্রণ করেছিলেন এই তিন ইনস্ট্রুমেন্টাল ট্র্যাকে। সৌভাগ্যের ব্যাপার, কয়েক বছর আগে ঢাকার পুরোনো ক্যাসেট-রেকর্ডের দোকানগুলো থেকে এই মহামূল্যবান অ্যালবামটি পেয়ে একজন ইউটিউবে আপলোড করেছেন।
প্রতিষ্ঠার বছর চারেক পরেই ব্যান্ডে প্রথম ভাঙন দেখা দিল। ড্রামার সাব্বির আর গিটারিস্ট রফিক ব্যান্ড ছেড়ে দিলেন। তাঁদের যন্ত্র কিনে নিলেন মিউজিশিয়ান ও ঢাকাই সিনেমার একসময়ের জনপ্রিয় নায়ক জাফর ইকবাল। এরপর ১৯৬৮ সালে সাব্বির ‘গোরি’ নামের একটা সিনেমায় নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ছবিটি ব্যবসায়িক সাফল্য না পাওয়ায় ১৯৬৯ সালে তিনি স্থায়ীভাবে আমেরিকায় চলে যান এবং ১৯৯১ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত অবস্থায় মারা যান। আর রফিক চলে যান হাওয়াইতে। তিনি বেঁচে আছেন কি না, তা জানা যায় না। তবে ২০০৩ সালের একটা সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, হাওয়াইতে তাঁর একটি ছোট ব্যান্ড আছে। তাঁরা দুজন ব্যান্ড ছেড়ে দিলে ফজলে রবের সঙ্গে যোগ দেন ল্যারি, রবিন ও সাকি। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না, মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁরা তিনজন ‘আগলি ফেসেস’ নামে নতুন ব্যান্ড বানালেন। আর ফজলে রব কিছুতেই কিছু করতে না পেরে ১৯৭৬ সালে সব ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন আমেরিকা। তখন এগিয়ে এলেন ওমর খালেদ রুমী, সঙ্গে পেলেন হ্যাপী আখান্দ্ আর ইদুকে। ভাঙাচোরা অবস্থায় কয়েক বছর গানবাজনা চালিয়ে যাওয়ার পর ইদুও চলে গেলেন আমেরিকা। এরপর আর মাথা তুলতে পারেনি আইওলাইটস ওরফে উইন্ডি সাইড অব কেয়ার। এভাবেই পুরোপুরিভাবে থেমে গেল স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে সৃষ্টি হওয়া প্রথম ব্যান্ডের পথচলা।
সূত্র: লতিফুল ইসলাম শিবলীর ‘বাংলাদেশে ব্যাণ্ড সঙ্গীত আন্দোলন’, রফিক মাযহার ইসলাম সাজু ও রফি ওমরের সাক্ষাৎকার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জর্জিনা হকের মন্তব্য
অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com