আজ প্রয়াত হলেন প্রথমা প্রকাশনের সমন্বয়কারী অরুণ বসু। মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন তারুণ্যদীপ্ত ও সাহিত্যরসিক মানুষ। তাঁকে শ্রদ্ধা
সবকিছুর একটা প্রস্তুতি থাকে। কিন্তু এই লেখা লেখার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না আমি। গত পরশু অরুণদা—প্রথমা প্রকাশনের সমন্বয়কারী অরুণ বসু—ফোন করে বললেন, ‘আমি হাসপাতালে ভর্তি। পারলে এসো। দেখতে মন চায়।’ কোনো কথা না বলে বললাম, ‘আমি আসছি।’ হাতের কাজ ফেলে রওনা দিলাম হাসপাতালের উদ্দেশে। দেখলাম ছয় ফুটের বেশি দীর্ঘ শরীরে হাসপাতালের বেডে ঠ্যাস দিয়ে বসে আছেন অরুণদা। যেন রামায়ণ-মহাভারত থেকে নেমে আসা কোনো মহানায়ক। কথার একপর্যায়ে পরিবেশ হালকা করতে কয়েকটা হাততালি দিলেন। বললেন, ‘যাও, যাও, দেখা হবে।’ চলে এলাম। গতকাল তাঁকে ফোন দেব দেব করেও দিইনি। ভাবলাম, যে মানুষ হাততালি দিয়ে আনন্দ করে বিদায় দিলেন, তাঁকে আজই আবার ফোন দিয়ে বিরক্ত না করি। তিনি সুস্থ আছেন। দেখা তো হবেই।
কিন্তু হায়...
আজ ভোরে ঘুম ভাঙতেই খোঁজ নেওয়ার জন্য ফোন হাতে নিলাম। তখনই ঘটল ঘটনাটা। জল্লাদের মতো আমার ফোন বেজে উঠল। প্রথম আলো থেকে ফোন পেলাম, ‘অরুণ বসু আর নেই...!’ খবরটা শোনার পর কী করব বুঝতে পারছিলাম না। কার কাছে যাব। কী বলব! কোথায় গেলে অরুণদাকে দেখতে পাব! ভাবতে ভাবতে কয়েকজনকে ফোন দিলাম। কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারল না কোথায় গেলে অরুণদাকে শেষবার দেখতে পাব। মনের মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল, আমি কি ঢাকায় অরুণদাকে দেখতে পাব না! তবে কি আমাকে অরুণদার লাশবাহী ফরিদপুরগামী গাড়ির অনির্দিষ্ট অবস্থান কল্পনায় রেখে দৌড়াতে থাকতে হবে তাঁর বাড়ি ফরিদপুরের উদ্দেশে? পরক্ষণেই ভাবলাম, কেন এমন মনে হলো! কাউকে দেখার জন্য এভাবে দৌড়ানোর কথা তো কখনো মনে হয়নি! কেন এমন হলো? অরুণ বসু আমার কী ছিলেন, আমাদের কে ছিলেন!
তাঁর মতো সাহিত্য ও সংস্কৃতিভোক্তা বাংলাদেশে খুব কমই দেখেছি। আড্ডায় বসে যে কাউকে চমকে দেওয়ার মতো যথেষ্ট রসদ ছিল অরুণ বসুর স্মৃতির ঝুলিতে। তিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উদাত্ত কিন্তু আতুর কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন ‘ইডিপাস’ নাটকের রাজা ইডিপাসের ট্র্যাজিক সংলাপ। আবৃত্তির মাধ্যমে ইডিপাসের হাহাকারকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যেতেন যে মনে হতো তিনিই ইডিপাস। গ্রিক মিথ থেকে এইমাত্র যেন নেমে এসেছেন মর্ত্যে, আমাদের সামনে
অরুণদা ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য সাংবাদিকতা করতেন। প্রথম আলোর সাংবাদিক ছিলেন। জানি এবং শুনেছি, তিনি সাংবাদিকতা-প্রশ্নে নির্ভর করার মতো মানুষ ছিলেন। সাংবাদিকতার বর্তমান হালহকিকতে সবাই এটা জানেন যে নির্ভর করার মতো মানুষ এ পেশায় খুব বেশি নেই। কিন্তু অরুণদার ক্ষেত্রে ছিল এহঃ বাহ্য। আমার চোখে তিনি একজন ‘নায়ক’ ছিলেন। না, তিনি কোনো নাটক-সিনেমায় অভিনয় করেননি। তাঁর যাপন আর জীবনের ভ্রমণটাই ছিল নায়কোচিত।
অরুণ বসু মফস্বলের ডালের আড়তের ম্যানেজার থেকে শুরু করেছিলেন নিজের জীবন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে কোনো দিন খুব একটা পোঁছেননি। আর প্রথম আলোর প্রথম শ্রেণির সাংবাদিক এবং সবশেষে প্রথমা প্রকাশনের সমন্বয়ক হিসেবে জীবন শেষ করলেন। এই যে যাত্রা থেকে মহাযাত্রা, এর ভেতরে আছে হাজারো উত্থান-পতনের গল্প। সেই গল্পের ঠাসবুননের সুতো বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিকাশের ইতিহাস। এসবে ঠাসা ছিল অরুণদার হৃদয় আর মাথা। মাঝখানে বড় একটা ফোঁড় ছিল। এই ফোঁড়ের নাম মুক্তিযুদ্ধ। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন দেশের পক্ষে; কিন্তু সার্টিফিকেট নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের তিনি ছিলেন এক জীবন্ত আকরগ্রন্থ। বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে সাংস্কৃতিক রুচি আর সুগন্ধ, সেই রুচি ও সৌরভের এক গভীর সান্দ্র রূপ ধরা পড়েছিল অরুণ বসুর চিন্তা, চর্চা আর পঠন-পাঠনে। তাঁর যাঁরা কাছের মানুষ, তাঁদের এ কথা অজানা নয়। কিন্তু এ নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনো আদিখ্যেতা ছিল না। ছিল না দেখনদারি বা প্রকাশবেদনা। তিনি লিখেছেন কম, বড় বেশি কম। কিন্তু তাঁর লেখা ছিল বড় লেখকের বাড়া। তুলোর মতো নরম আর আরামদায়ক গদ্য লিখতেন। সেই গদ্য গভীরতায় আর নৈঃশব্দ্যে ছিল ঝিমধরা।
তাঁর মতো সাহিত্য ও সংস্কৃতিভোক্তা বাংলাদেশে খুব কমই দেখেছি। আড্ডায় বসে যে কাউকে চমকে দেওয়ার মতো যথেষ্ট রসদ ছিল অরুণ বসুর স্মৃতির ঝুলিতে। তিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উদাত্ত কিন্তু আতুর কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন ‘ইডিপাস’ নাটকের রাজা ইডিপাসের ট্র্যাজিক সংলাপ। আবৃত্তির মাধ্যমে ইডিপাসের হাহাকারকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যেতেন যে মনে হতো তিনিই ইডিপাস। গ্রিক মিথ থেকে এইমাত্র যেন নেমে এসেছেন মর্ত্যে, আমাদের সামনে। আর পাঁজর মেলে তুলে ধরছেন অলোকসামান্য ট্র্যাজেডির কথা; অসহায়তার কথা। তাঁর কাছেই শুনেছি, এই ‘ইডিপাস’-এর অভিনয় দেখার জন্য তিনি ফরিদপুর থেকে চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। শুধু কি ‘ইডিপাস’! তিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আবৃত্তি করতেন ‘বিষাদ-সিন্ধু’ থেকে। আওড়ে যেতেন সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রবন্ধ; এক দুই তিন চার লাইন নয়, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। লালন, কবিগান আর কীর্তনের মিশেলে তৈরি করতেন এক ইন্দ্রজাল। তাঁর সামনে যে কারও অসহায় হয়ে উপভোগ করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কিছু বলতে যাওয়া বা অংশগ্রহণ করতে যাওয়াটাই ছিল এক লজ্জার ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথের গান যে পড়া যায় এবং গভীর অনুরাগে আবৃত্তি করা যায়, সে পাঠ আমরা অরুণদার কাছ থেকেই নিয়েছি। এই যে কবিগান, লালন থেকে শুরু করে ‘ইডিপাস’ ও রবীন্দ্রনাথকে একসঙ্গে উপভোগের আওতায় নিয়ে আসা, এটা অরুণ বসুর পক্ষেই সম্ভব ছিল। এই বিচিত্র পথঘাট মাড়ানো অরুণদা সাহিত্য সম্পর্কে চকিত যেসব মন্তব্য করতেন, তা অবাক করত আমাদের। একদিন তিনি চকিতেই মন্তব্য করে বসলেন, বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক লেখক। যে কথাটি গবেষকেরা হুমায়ূন আহমেদের হাজার পৃষ্ঠা পড়ে আবিষ্কার করতে পারেন না, সেই কথা অরুণ বসু উচ্চারণ করে উঠতেন চা খেতে খেতে। হায়! কোথায় পাব তারে!
অরুণদার উচ্চতা ছিল সাধারণ বাঙালির চেয়ে চোখে পড়ার মতো বেশি। ভিড়ের মধ্যে দূর থেকেই তিনি চোখে পড়তেন। কিন্তু এটা বাহ্যকথা। আসল উচ্চতা ছিল তাঁর হৃদয়ে আর মননে। বাইরের গম্ভীর মুখাবয়বের আড়ালে তাঁর একটা স্নেহশীল-উদার হৃদয় ছিল। সেখানে ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল একাসনে বসতে পারত; হৃদয়ের ওম অনুভব করতে পারত। তিনি ছোট-বড় ভেদ করতেন না। কম খ্যাত তরুণ লেখকের ভালো লেখা পড়ে তাঁকে উদ্বেলিত হতে দেখেছি; আলাপে মত্ত হতে দেখেছি। আবার এই মানুষই প্রায় প্রতিদিনকার সম্পর্কের মধ্যে এসেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান থেকে শুরু করে লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, অরুণ সেন, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখের। তবে সব সময় অরুণদার চলাফেরা ছিল মূলত তরুণ মহলে। তথ্যে, পঠনপাঠনে আর চিন্তায় তিনি ছিলেন আজকের দিনের। আটষট্টিতেও তারুণ্যে টগবগ করতেন অরুণদা। প্রথম আলো অফিসে আসলেই দূর থেকে দরাজ আর দরদি গলায় ডাক ছেড়ে বলে উঠতেন, হুদা...! এই ডাক আর শুনব না—এ কথা ভাবতেই পারছি না।
আজ যখন প্রথম আলোতে বসে লেখাটি লিখছিলাম, হঠাৎ কার যেন একটা ভরাট কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলাম। মনে হলো অরুণদা পেছন থেকে হাততালি দিচ্ছেন আর ‘হুদা...’ বলে তরুণ কণ্ঠে ডেকে উঠেছেন। চকিতে পেছন ফিরলাম। পেছন ফিরে মনে হলো, এ আমি কী করছি! অরুণদা তো নেই! হায়! এভাবে চলে যেতে হয়, এভাবে কেউ যায় নাকি, অরুণদা!