অনুবাদ-অযোগ্য কাফকা

>

ফ্রানৎস কাফকার গল্পসমগ্র নামে কাফকার রচনার বড় অংশ অনুবাদ করেছেন মাসরুর আরেফিন। তিনি লিখেছেন তাঁর অভিজ্ঞতা

ফ্রানৎস কাফকা অনুবাদ কোনো দিনই সহজ না। নিচের এই বিখ্যাত কাফকা-প্রবচনটার কথাই ধরা যাক। কাফকা বলছেন: ‘আপনি নিজেকে এ পৃথিবীর জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারেন, সেই সম্ভাবনা আপনার জন্য খোলা আছে এবং তা আপনার মানবস্বভাবের সঙ্গে যায়ও, কিন্তু সম্ভবত এই প্রত্যাহার করে নেওয়াটাই একমাত্র জ্বালা-যন্ত্রণা, যা আপনি এড়াতে পারতেন।’ এটাই এই প্রবচনের আক্ষরিক অনুবাদ, যেহেতু আমি মোট পাঁচটা ইংরেজি অনুবাদ দেখে নিয়ে তারপর এটার মূল জার্মান শব্দগুলো বুঝে মোটামুটি এ সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছি যে এটাই আক্ষরিক।

এ তো গেল অক্ষরবিষয়ক অর্থাৎ টেক্সুয়াল কথা। কিন্তু অর্থ? কী অর্থ হয় এই পায়ের নিচের জমিন সরিয়ে নেওয়া প্রবচনটার? কোথায় গিয়ে এর অর্থ যেন ভাসা-ভাসা ধরা দেয়, মনে হয় কাফকা এখানে সম্ভবত পরিবার-পরিজনের কথা বলছেন, কিংবা যৌনতা বা সহিংসতার কথা, কিংবা মেটাফিজিক্স, যা ছিল তাঁর পড়াশোনার অন্যতম প্রিয় বিষয়। তারপরই মনে হয় ধুম করে সব অর্থ উধাও।

এই যে কাফকার শব্দে শব্দে ভরে রাখা অর্থ এবং বাড়তি অর্থ, যা নিয়ে থিওডর অ্যাডর্নো বলেছিলেন, ‘কাফকার প্রতিটা বাক্য চিৎকার করতে থাকে, “আমাকে ব্যাখ্যা করো”, কিন্ত কোনো বাক্যই সে অনুমতি দেয় না।’ তাই একদিকে পাঠকের জন্য যেমন কাফকা পড়া আনন্দের (বা যাতনার), অন্যদিকে অনুবাদকের জন্য তা এক ভয়াবহ মানসিক পীড়নের।

মাসরুর আরেফিন অনূদিত এবং পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিত ফ্রানৎস কাফকার গল্পসমগ্র–এর প্রচ্ছদ

কোনো শব্দ বদলে দিলে প্রতিটা অর্থ বদলে যায়, নতুন অর্থ খাড়া হয়—এ অনেক সাধারণ কথা। আর কাফকা অনুবাদে ভুল শব্দ নিয়ে এলে, কাফকার টেক্সুয়াল অনুবাদের বাইরে গিয়ে ‘সাংস্কৃতিক অনুবাদ’, ‘ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ’, ‘অর্থপ্রদায়ী অনুবাদ’, ‘পুনর্লিখনমূলক অনুবাদ’ ইত্যাদি করে বসলে শুধু নতুন অর্থই খাড়া হয় না বা কাফকা যে অর্থ করতে চেয়েছেন তা ভেঙে যায় না, পুরো কাফকা–পাঠের আনন্দই (যার অন্য নাম যাতনা) হারিয়ে যায়।

কেন? কারণ কাফকা নিগূঢ়ভাবে শব্দভিত্তিক—এতখানিই যে তাঁর শব্দগুলোর ব্যঞ্জনা ও দ্যোতনার মধ্যে হারিয়ে গিয়ে নিজেকে একসময় বলতে হয়, ‘আমি এই টেক্সটের কিচ্ছু বুঝছি না।’ ওই যে না বোঝার ‘গিল্ট’, ওই যে অর্থের কাছে পৌঁছাতে না পারার বেদনাবোধ এবং না-বোঝা অর্থ অন্যকে বোঝাতে না পারার ভাষিক অক্ষমতা, সেই অধরা অনুভূতিটার নামই কাফকা-পাঠ।

অতএব কাফকা–অনুবাদকে আক্ষরিক না হয়ে কোনো উপায় নেই, কাফকার শব্দগুলো নিয়ে অনুবাদকের খেলা করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি আমাদের জীবন যাপনের ক্ষতগুলোকে তাঁর লেখায় চুলকে চুলকে রেখেছেন, ঠিক সেসব জায়গায় যেখানে ক্ষতগুলো চুলকাচ্ছে। ব্যাপারটা এতটাই দৈনন্দিন যে আমরা তা ধরে উঠতে পারছি না, আমাদের কাছে বিষয়টা তার অর্থই হারিয়ে ফেলেছে, আমরা মোটাদাগে একেই ‘জীবনযাপন’ বলে ছেড়ে দিয়েছি, কিন্তু কাফকা দেননি। তিনি বরং তাঁর ঘোরানো-প্যাঁচানো বাক্যের মধ্যে আমাদের পরিচিত করাচ্ছেন, আমরা যা ভুলে গেছি; যা যা আমাদের কাছে অপরিচিত হয়ে গেছে সেসবের সদর দরজা থেকে শুরু করে অন্দরমহল পর্যন্ত। অর্থাৎ আপনি-আমি জীবনকে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রেখে ছেড়ে দিয়েছি, যাপন করে যাচ্ছি, আর কাফকা তাঁর টেক্সটে সেটার ‘যৌক্তিকতাকরণ’ করে চলেছেন।

এ কারণেই বলা হচ্ছে কাফকার টেক্সট নিয়ে সাবধানে নাড়াচাড়া করো, ওর শব্দগুলো কোনো রকম এদিক-ওদিক কোরো না, অন্য কেউ তাঁর মতো জীবনের অর্থ বা অনর্থবোধকতা নিয়ে শব্দের খেলা করেননি, তাঁর শব্দগুলোর আপাত অর্থহীনতাই তাঁর অর্থ, ইত্যাদি। অর্থাৎ কাফকা অনুবাদকদের গবেষণা, পুনর্গবেষণার হাত ধরে ধরেই আমাদের চোখের সামনে কাফকা ‘প্রফেটিক’ হয়ে উঠলেন, আর তাঁর টেক্সট হলো ধর্মগ্রন্থের মতো ‘পবিত্র’ যেন।

এরই মধ্যে মিলান কুন্ডেরা তাঁর কাফকা-অনুবাদ বিষয় প্রবন্ধ ‘একটি বাক্য’-তে লিখে বসলেন যে একই শব্দ কাফকা যেভাবে পুনঃ পুনঃ ব্যবহার করেন, ওই শব্দের যে ধ্বনি আমরা শুনি, যে বিরামচিহ্ন আগে বা পরে রেখে ওই শব্দ পাতার ওপরে দাঁড়ায়, আর যেরকম লম্বা লম্বা প্যারাগ্রাফ শব্দগুলোকে একসঙ্গে বেঁধে রাখে, তা জয়েস বা ফকনারের মতো স্টাইলিস্টদের খেলা না, মার্সেল প্রুস্তের মতো শব্দের নন্দনতত্ত্ববিষয়ক পরীক্ষাও না, তা কাফকার ভাষা থেকে দূরত্ব বা বিচ্ছিন্নতা এবং তাঁর ভাষাবিষয়ক যাতনার স্মারক। অর্থাৎ যা বলতে চাইছি তা আর বলতে পারছি না, এ রকম এক বোধের চূড়ান্ত মুহূর্তে কাফকা নিজের মাথার চুল না ছিঁড়ে পাতার ওপরে ধুম করে বসিয়ে দিলেন একটা বড় ড্যাশ কিংবা শব্দের আগে একটা আপাত অকারণ সেমিকোলন। ‘প্রফেটিক’ টেক্সট বলে অনুবাদককে ওই অকারণ সেমিকোলনটাও রাখতে হচ্ছে, কারণ কে জানে কি–না–কি হারিয়ে যায় সেটা না রাখলে!

আমার কাফকা-অনুবাদ ওই কঠিন নিয়ম মেনে চলছে না, বোরহেস-কুন্ডেরা-অ্যাডর্নোর খাড়া করা ‘প্রফেটিক’ কাফকা-টেক্সটের প্রতি যথেষ্ট সম্মান দেখিয়ে তা এগুচ্ছে না, বরং প্রতিটা বাক্য বাংলায় গেরস্থিকরণ হয়ে যাচ্ছে, আবার তা না হলে বাংলা বাক্য অতিরিক্ত কমিক্যালি ‘কাফকায়েস্ক’ হয়ে যাচ্ছে—এ রকম পীড়ন-জ্বালাতনের এক চূড়ান্ত মুহূর্তে আমি ২০১২ সালের গ্রীষ্মে গিয়ে হাজির হলাম প্রাগের ‘কাফকা সোসাইটি’র দরজায়। বললাম, আমি বিভ্রান্ত, আমাকে সাহায্য করো, এই যে এই-এই-এই জায়গাগুলো আমাকে বোঝাওকাফকা সোসাইটির জ্ঞানী প্রধান (যাঁর নাম আমার মনে নেই) এবং তাঁর সুন্দরী সহকর্মী জুজানা ভেরনারোভা আমাকে উত্তরে বললেন, ‘প্রথমে তুমি প্রাগের সমস্ত কাফকা-সংশ্লিষ্ট রাস্তা, বাড়ি, অলিগলি ঘুরে আসো, তারপর চলো তোমার সমস্যাগুলো নিয়ে বসি।’ দুদিনের মধ্যে পুরো প্রাগ, যার ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে আছেন কাফকা, ঘুরে এসে সেই সব ম্যাপ, সেই সব রাস্তাঘাটের ইট–বালি–সুরকি, আলোকচিত্র এবং তাঁর ছয়-সাতটা ইংরেজি অনুবাদ পাশে রেখে, সেই সব পুরোনো দালানের হারানো দীর্ঘশ্বাস পকেট থেকে বের করতে করতে যখন আমি ফের বসেছি তাঁদের সঙ্গে, তাঁদের গ্রন্থাগারের আলোআঁধারি রুমে, ততক্ষণে এটুকু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, কাফকা আপনার নিজের মাথা দেয়ালে ঠুকতে ঠুকতে পাঠযোগ্য, কিন্তু তিনি অনুবাদ-অযোগ্য।