অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের একাডেমিক উদারনীতি ও আমার অভিজ্ঞতা

১৪ মে ছিল জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রথম মৃত্যুদিন।

আনিসুজ্জামান (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭—১৪ মে ২০২০)

একাডেমিক চর্চা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেই উদারনৈতিক। দশজনের মতকে আমলে আনতে হয়, তথ্য-উপাত্ত ও উদাহরণ ব্যবহার করতে হয় আর প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি ও মতের সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অবশ্য অনুদার বা রক্ষণশীল চর্চার ঘটনাও একাডেমিতে হামেশাই ঘটে। স্কুলগত ফারাকের কারণে কোণঠাসা হয়েছে—এমন ঘটনা একাডেমিক জগতে মোটেই বিরল নয়। আর বাংলাদেশের মতো দুর্বল একাডেমিতে, যেখানে মানসম্মত গবেষণার কোনো সিলসিলাই আদতে গড়ে ওঠেনি, সেখানে একাডেমিক উদারনীতি বিষয়ে আলাপটা একটু ভিন্ন ধরনের হবে। উদারতা এখানেও আছে। তবে তা প্রধানত অপ্রস্তুতি ও অমনোযোগজনিত শৈথিল্যের কারণে।

তরুণ আনিসুজ্জামান এই শিথিল একাডেমিতেই কাজ শুরু করেছিলেন। খুব কম বয়সে তাঁর পিএইচডি শেষ হয়েছিল। ওই গবেষণাকর্ম বই হিসেবে যখন বের হয়, তখনো তাঁর বয়স খুব বেশি নয়। কিন্তু বইটি দুই বাংলায় সুনাম কুড়িয়েছিল। কাজের বই হিসেবে সম্মান পেয়েছিল। বিশ শতকের ষাটের দশকে ঢাকার কোনো গবেষণাকর্ম দুই বাংলায় সমাদৃত হওয়া এবং সে সমাদর আজতক অক্ষুণ্ন থাকা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তথ্য-উপাত্তের সুশৃঙ্খল ব্যবহার এবং গবেষকের উদার দৃষ্টি নিঃসন্দেহে ওই সমাদর ও সম্মানের মূল কারণ। অনেক পরে আহমদ ছফা প্রণীত যদ্যপি আমার গুরু বইয়ের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, আনিসুজ্জামান যে রকম গুছিয়ে গবেষণা করতে পারে, সে রকম খুব একটা দেখা যায় না। আমি একবার স্যারকে সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি হেসে বলেছিলেন, পরে বেশি গবেষণাকর্ম করিনি বলে রাজ্জাক স্যারের খুব দুঃখও ছিল।

গবেষক আনিসুজ্জামান যে ঢাকা বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি, সে কথা পুরোপুরি বলা যাবে না। ছাত্রজীবনে এবং পিএইচডি গবেষণার কালে তাঁর সামনে নিশ্চয়ই কলকাতা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু মান আদর্শ হিসেবে কাজ করেছে। পরে তিনি গবেষণা করেছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে, লন্ডনে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে এবং দুনিয়ার আরও নানা জায়গায়। এর মধ্য দিয়ে অন্তত দুই ক্ষেত্রে তাঁর বড় অর্জন হয়েছিল। এক. বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় আসক্তিহীন অনুচ্চ মেজাজে বিবরণী তৈরি করতে পারা; দুই. তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে উপনীত সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার উদারনীতি। পিএইচডি-ছাত্র হওয়ার সুবাদে আমি তাঁর এ দুই গুণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পেয়েছি।

পিএইচডির জন্য গবেষণার এলাকা ও শিরোনাম আমি আগেই ঠিক করেছিলাম। শিরোনামটি ছিল, ‘উপনিবেশ আমলে লেখ্য-বাংলার রূপ ও রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষাচিন্তা’। তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে আমি আনিসুজ্জামান স্যারের কথাই ভেবেছিলাম। তার এক কারণ, গবেষক হিসেবে দেশে-বিদেশে তাঁর যে খ্যাতি ও প্রতিপত্তি ছিল, আমি তার ভাগ নিতে চেয়েছি। আমি জানতাম এবং এখনো জানি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পদ্ধতিগত কোনো ধারাক্রম প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একাডেমির অনুপস্থিতিতে ব্যক্তির কুশলতার ওপর আমি ভর করতে চেয়েছিলাম। তা ছাড়া দেশে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানই ছিলেন প্রায় একমাত্র পণ্ডিত, যিনি উনিশ শতক ও পুরোনো বাংলা গদ্য সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা করেছেন। উনিশ শতক তাঁর গবেষণার প্রধান এলাকা। এ সময়ের নানা বিষয়ে তাঁর গভীর পাণ্ডিত্যের পরিচয় আমি আগে ও পরে বহুবার পেয়েছি। অন্যদিকে, উনিশ শতকের আগের বাংলা গদ্য নিয়ে কাজ হয়েছে তুলনামূলক অনেক কম। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ-পরবর্তী গদ্যচর্চা সবার মনোযোগ এতটাই দখল করে আছে যে পুরোনো গদ্যের দিকে যথেষ্ট মনোযোগী হওয়ার অবকাশ পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে আনিসুজ্জামানের গবেষণা ও আবিষ্কার বেশ গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকৃত ও গৃহীত হয়েছে।

আনিসুজ্জামান স্যার আমার তত্ত্বাবধায়ক হতে সম্মত হন কি না, তা নিয়ে আমি একটু দ্বিধায় ছিলাম। তিনি তখন ইমেরিটাস অধ্যাপক। কাজেই কারও গবেষণার দেখভাল করা তাঁর আনুষ্ঠানিক দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে না। খামাখা একটা বোঝা কে আর ঘাড়ে চাপাতে চায়? কিন্তু তিনি সহজেই সম্মত হলেন। আমার গবেষণা-প্রস্তাব দেখে দিলেন। সামান্য অদলবদল করলেন। কিছু পরামর্শ দিলেন। এ ধারা থিসিস লেখার শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তাঁর সঙ্গে আমি এ কাজে মোটামুটি চার বছর সম্পর্কিত ছিলাম। তাতে তাঁর সক্ষমতা ও ঔদার্যের অনেকগুলো দিকের সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ পরিচয় হয়েছিল।

প্রথমেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর সময়ানুবর্তিতা। ওই বয়সেও তিনি কাজ করতেন প্রচুর। বিস্ময়করভাবে বেশি। আমি প্রথম কিছু অংশ লিখে তাঁকে দেখতে দিয়েছিলাম। তিনি পৃষ্ঠাগুলো রাখলেন। বললেন, এটা দেখে দিতে দেরি হবে। এই বলে তিনি পরের তিন মাসে কী কী কাজ করবেন, তার একটা তালিকা বললেন। তার মধ্যে দেশি-বিদেশি লেখা, সম্পাদনা, বিদেশে যাওয়া ইত্যাদি নানান কাজের কথা ছিল। আমাকে বললেন, তোমার কাজটা পাবে এর পরে। বিলম্ব দেখে আমি একটু মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলাম। কিন্তু যে তারিখ তিনি বলেছেন, তার কোনো হেরফের হয়নি। পরের চার বছরের পুরো সময়টাতে তাঁর ঠিক করে দেওয়া সাক্ষাতের সময়ে তিনি ব্যতিক্রমহীনভাবে অফিসে উপস্থিত ছিলেন। এবং ঠিক যে সময়ে যা করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন, যেমন কোনো অংশ দেখে দেওয়া, কোনো বই নিয়ে আসা ইত্যাদি, তা ঠিকঠিক পালন করেছিলেন।

বাংলা ও ইংরেজি ভাষার কপি সম্পাদনায় তাঁর কুশলতাও আমাকে মুগ্ধ করেছিল। ভাষা-দক্ষতা ছাড়াও কপি সম্পাদনার জন্য দরকার প্রত্যয়। এ প্রত্যয় আসে বিষয়ের পাণ্ডিত্য থেকে। আমি চার বছরে তার বিস্তর প্রমাণ পেয়েছি। কিন্তু পাণ্ডিত্য ও কুশলতার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তাঁর স্বভাব ও আচরণের ঔদার্য। আমি ঠিক নিশ্চিত নই, তাঁর সাফল্য এবং পাণ্ডিত্য এ ঔদার্যে কতটা ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু তাঁর আচরণের মার্জিত আভিজাত্যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না। আমি তাঁকে উচ্চকণ্ঠে কথা বলতে শুনিনি; কোনো বেফাঁস কথা তিনি মুখ ফসকে বলে ফেলেননি, যা পরে প্রত্যাহার করতে হয়েছে; কারও নিন্দা করেছেন বলেও মনে পড়ে না। এমনকি তাঁর ছাত্র হিসেবে আমি যেন কোনোভাবে মনস্তাত্ত্বিক চাপে না থাকি, সেদিকেও তাঁর কড়া নজর ছিল।

শুরুতে যে একাডেমিক উদারতার কথা বলেছিলাম, এসব গুণ মোটেই তার বাইরের জিনিস নয়। বরং একে বলতে পারি আচরণের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংস্কৃতি, একাডেমির উদার সংস্কৃতির সঙ্গে যার গভীর সম্পর্ক আছে। ওই ঔদার্যের প্রত্যক্ষ উদাহরণ এবার দেওয়া যাক। পিএইচডির প্রথম সেমিনারে আমার শিক্ষক ও সহকর্মীদের অনেকেই হাজির ছিলেন। আমার উপস্থাপন শেষে সাঈদ-উর রহমান স্যার আনিসুজ্জামান স্যারের উদ্দেশে বললেন, স্যার, আপনি আমাদের পড়িয়েছিলেন, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের গদ্যগ্রন্থগুলো পরের বাংলা গদ্যে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু আজম তো সম্পূর্ণ ভিন্ন সিদ্ধান্ত জানাল। আনিস স্যারের পেপারটা আগেই পড়া ছিল। কাজেই কালবিলম্ব না করে বললেন, অপেক্ষাকৃত বেশি এবং নতুন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আজম নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাজেই এটা ঠিকই আছে।

উনিশ শতক ও বাংলা গদ্যের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা না থাকলে এখানে উদারতার ব্যাপারটা ঠিক কোথায় কতটা ঘটল, তা বুঝে ওঠা সহজ হবে না। আসলে শুধু এ ক্ষেত্রে নয়। ব্যাপারটা ঘটেছে আমার পুরো থিসিসজুড়েই। উনিশ শতকের যে ধরনের মূল্যায়ন ও গুরুত্বের ওপর অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রায় যাবতীয় সিদ্ধান্ত গড়ে উঠেছে, আমার থিসিস প্রাথমিকভাবে তার একটা অ্যান্টি–থিসিস। তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে এ বস্তু অনুমোদন করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রশংসা করাকে উদারনীতির একটা বিশিষ্ট মাত্রা বলেই সাব্যস্ত করতে হয়।

তার মানে আবার এ নয়, তিনি তাঁর মত বদল করেছেন। মোটেই নয়। স্বমতে নিষ্ঠ থেকেও সুশৃঙ্খলভাবে উৎপাদিত ভিন্নমতে সমর্থন জানানো একাডেমিক সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান সৌন্দর্য। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মধ্যে যে সে উদারতা কার্যকরভাবে বিকশিত হয়েছিল, বহুজন সে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আমাদের সমাজে ভদ্রলোকশ্রেণির মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা ও ঔদার্যের বিরাট ঘাটতি দেখা যায়। একাডেমিক সংস্কৃতির অনুপস্থিতি কি তার অন্যতম প্রধান কারণ?