বিশ্বব্যাকরণ ধারণার প্রবক্তা মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী নোয়ম চমস্কির মতে, খ্রিষ্টপূর্ব যুগে ভারতবর্ষের বৈয়াকরণ পাণিনির লেখা অষ্টাধ্যায়ী মানবভাষার প্রথম সার্থক ব্যাকরণ। আণবিক মডেলের প্রবক্তা পাণিনির হাজার বছর পর (৮ম শতক) উপমহাদেশের আরেক বৈয়াকরণ ভর্তৃহরি বলেন, ‘প্রতিটি শব্দই অখণ্ড। শব্দকে বিশ্লেষণ করার পাণ্ডিত্য কেবলই পণ্ডশ্রম।’ তবু পাণিনির মতো বড় বটগাছের ছায়ায় অন্য গাছ যেন জন্মাতে পারে না। তাই তো পাণিনির দুই হাজার বছর পরও প্রথম বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথকে আক্ষেপ করতে হয়—‘আমরা বাংলা ব্যাকরণ নাম দিয়া সংস্কৃত ব্যাকরণ পড়িয়া থাকি, তাহাতে অল্প পরিমাণ বাংলার গন্ধ মাত্র থাকে।’ রবীন্দ্রনাথ বাংলা শব্দতত্ত্ব (১৯০৯), বাংলা ভাষার পরিচয় (১৯৩৮) ইত্যাদি মূল্যবান প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করলেও, ‘যথার্থ বাংলার বৈজ্ঞানিক ব্যাকরণ’ রচনার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। হুমায়ুন আজাদ সঞ্জননী তত্ত্বের আলোকে বাক্যতত্ত্ব (১৯৮৪) লিখলেও রূপান্তরমূলক কারক-ব্যাকরণ কাঠামোতে ‘বাঙলা ব্যাকরণের রূপরেখা: একটি প্রস্তাব’ (১৯৮৯) নামে প্রবন্ধ লিখেই ক্ষান্ত হন; পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনার অবকাশ পাননি। সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় বিদ্বৎ প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আকাদেমির সহযোগিতা নিয়ে প্রকাশ করে প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ (২০১১)। দুই বাংলার ৩১ জন ভাষাবিজ্ঞানীর ভাষাচিন্তার সমন্বয়ে দুই খণ্ডে প্রকাশিত এ বইকে বলা যায় বাঙালির বাংলা ব্যাকরণচর্চার প্রথম সমবেত প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস। সাধারণ পাঠক, ভাষা ব্যবহারকারী এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন ও উপযোগিতার ভিত্তিতে সম্পাদকত্রয় রফিকুল ইসলাম, পবিত্র সরকার ও মাহবুবুল হক কর্তৃক প্রণীত হয় প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ (২০১৪)। এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে শিশির ভট্টাচার্য্য লিখলেন, বাংলা ব্যাকরণের রূপরেখা (২০১৬) নামে নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে বাংলা ব্যাকরণ। বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপেই ঘোষণা করা হয়েছে, এটি সম্ভবত বাংলা ভাষার প্রথম ‘অ-সংস্কৃত’ ব্যাকরণ।
বাংলা ব্যাকরণের রূপরেখা
শিশির ভট্টাচার্য্য
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল l
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: মে ২০১৬ l
২৫৬ পৃষ্ঠা l
দাম: ৪৫০ টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞানী শিশির ভট্টাচার্য্য ইউরোপ, আমেরিকা আর এশিয়া—এই তিন মহাদেশে ব্যাকরণচর্চার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন প্রায় তিন দশক ধরে। এটি তাঁর তৃতীয় বাংলা ব্যাকরণবিষয়ক বই। এর আগে তিনি লেখেন সঞ্জননী ব্যাকরণ (১৯৯৮) ও অন্তরঙ্গ ব্যাকরণ (২০১৩)। এগুলো বাংলা ভাষার বিভিন্ন অংশের আংশিক বিশ্লেষণ হলেও এবার অধিকতর অভিজ্ঞ গবেষক অগ্রসর হলেন বাংলা ভাষার পূর্ণাঙ্গ বর্ণনার আকাঙ্ক্ষায়। অবশ্য এখানে তিনি প্রমিত বাংলার বাক্যতাত্ত্বিক বর্ণনা বর্জন করেছেন। রাজেন্দ্র সিংহ প্রবর্তিত ‘সঞ্জননী ধ্বনিকৌশল’ মডেলটি ব্যবহার করে সার্থকভাবে বাংলার ধ্বনিতত্ত্ব বর্ণনা করেছেন। রাজেন্দ্র সিংহ ও অ্যালান ফোর্ড প্রবর্তিত ‘অখণ্ড রূপতত্ত্ব’-এর আলোকে আলোচনা করেন বাংলা রূপতত্ত্ব। বাংলা ব্যাকরণের রূপরেখা বইয়ে দুটি পর্ব: ব্যাকরণ পর্ব ও সংযুক্তি পর্ব। পাঁচটি অধ্যায় নিয়ে ব্যাকরণ পর্বে লেখক বাংলা ভাষা ও বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের রূপরেখা, অখণ্ড রূপতত্ত্ব, প্রমিত বাংলার রূপতাত্ত্বিক বিবরণ ও প্রমিত বাংলার রূপতাত্ত্বিক চিত্র প্রাঞ্জল ভাষায় উন্মোচন করেন। এখানে লেখক অখণ্ড মডেলের যৌক্তিকতা উপস্থাপনের পাশাপাশি আণবিক মডেলের সীমাবদ্ধতা-দোষত্রুটি দেখান নির্মোহ ভঙ্গিতে। এই ব্যাকরণ পাঠে পাঠক জানতে পারেন দুই মডেলের পার্থক্য। আণবিক মডেলে শব্দের আন্তর্গঠন বিচার-বিশ্লেষণ করা হয় যে শাস্ত্রে তার নাম রূপতত্ত্ব। অথচ অখণ্ড মডেলে শব্দের কোনো আন্তর্গঠন নেই, শব্দ অখণ্ড, অটুট। এখানে তাই ব্যাকরণের যে উপাঙ্গটি ব্যবহার করে মানুষ নতুন শব্দ গঠন করতে পারে বা কখনো না শোনা নতুন শব্দ শুনে বুঝতে পারে বা কোনো কারণে মনে না পড়া শব্দ মনে করতে পারে, তা-ই রূপতত্ত্ব।
সংযুক্তি পর্বে ‘আণবিক সংযুক্তি’ শিরোনামযুক্ত অংশে পাঠকের অভ্যাসের কথা মাথায় রেখে আলোচিত হয়েছে পাঁচটি সংযুক্তি: ১. উপসর্গ ও প্রত্যয়, ২. সমাস, ৩. বীপ্সা, ৪. সন্ধি আর ৫. বাংলা বানানের বিধান। এখানেও শিশির ভট্টাচার্য্য একে একে দেখান এগুলোর অপ্রয়োজনীয়তা। যেমন: সন্ধি সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, ‘সন্ধির যে নিয়মগুলো স্বয়ংক্রিয় ধ্বনিপরিবর্তনের নিয়ম, সেগুলো কোনো বাংলাভাষীকে শিখতে হয় না। ...সন্ধির যে নিয়মগুলো বিশেষ বিশেষ রূপকৌশলের অংশ, সেগুলো রূপকৌশলের অঙ্গীভূত হয়েই রূপতাত্ত্বিক উপাঙ্গের অংশ হয়ে থাকে।’ সুতরাং তাঁর যৌক্তিক সিদ্ধান্ত, ‘এক সংস্কৃত ব্যাকরণের ঐতিহ্য আর বহুচর্চিত অভ্যাসের অজুহাত ছাড়া বাংলা ব্যাকরণে সন্ধি নামক অধ্যায়টি রাখার আর কোনো যুক্তি আছে বলে আমার মনে হয় না।’ বানান সম্পর্কেও তাঁর একই কথা, কেননা বানানের বিধান ব্যাকরণের নিয়ম নয়, বিধান বা কানুন মাত্র। পাঠককে তিনি প্রথম অধ্যায়েই জানিয়ে দেন, ‘নিয়মগুলো ভাষার স্বাভাবিক প্রকৃতির অংশ।...বৈয়াকরণেরা যেসব অনুশাসন ভাষাব্যবহারকারীদের ওপর চাপিয়ে দিতে চান, সেগুলোকে বলা যেতে পারে কানুন। ...সুতরাং, ভাষার নিয়মকানুনকে আমরা ব্যাকরণ বলব না, শুধু নিয়মগুলোকেই ব্যাকরণ বলব।’
এভাবে ব্যাকরণের নতুন সংজ্ঞা-পরিভাষা আর নতুন কয়েকটি বৈয়াকরণিক তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা ভাষার বিশ্লেষণ সংস্কারমুক্ত পাঠকচিত্তে আনন্দ জোগাবে। এর নতুন আলোয় আলোকিত হয়ে নবীন ভাষাগবেষকেরা ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা ভাষাকে বিশ্লেষণে অনুপ্রাণিত হবেন। বাংলা ভাষার নিয়ম জানতে আগ্রহী সাধারণ পাঠকের কাছেও ব্যাকরণ বইটি সহজপাঠ্য বলে বিবেচিত হবে।