সুলতানা কামাল।
সুলতানা কামাল।

‘বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও’ আহ্বানভিত্তিক নাগরিক সমাজের জাতীয় সম্মেলন

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চলমান লড়াইয়ে অংশ নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্ম ব্যবসায়ী শক্তিকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে নাগরিক সমাজ। গতকাল শনিবার সকালে অনুষ্ঠিত নাগরিক সমাজের জাতীয় সম্মেলনে এই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, এটি দেশের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এ লড়াই থেকে কারও পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। অতীতের মতো এ লড়াইয়েও সবাইকে নাগরিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে।

রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবিগুলো হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা; যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করা; সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানো; মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নেওয়া ও মুক্তচিন্তার পথ খোলা রাখা; তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর পাঁয়তারা প্রতিহত করা ও নারীর অধিকার সমুন্নত রাখা।‘বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও’ আহ্বানভিত্তিক ওই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

ছায়ানটের শিল্পীদের পরিবেশিত জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে সম্মেলন শুরু হয়। এরপর সম্মেলনে শোকপ্রস্তাব উত্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম আকাশ। পাঁচ দফা দাবিসংবলিত সম্মেলনের ঘোষণা পাঠ করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী।গণজাগরণ মঞ্চসহ ঢাকা ও বাইরের নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেকে সম্মেলনে যোগ দেন। অংশগ্রহণকারীদের মুহুর্মুহু স্লোগানে সম্মেলনস্থল ছিল মুখরিত। সম্মেলন চলাকালে অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও বিভিন্ন ব্যক্তি এর লক্ষ্যের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। বামপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সম্মেলনস্থলে উপস্থিত ছিলেন। সূচনা বক্তব্য দেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল।.

তিনি জামায়াত-শিবির, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এখন আর এ লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই। সম্মেলনে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিতে অতীতের মতো মূল্য দিতেও আমরা প্রস্তুত।’ তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তিকে সারা দেশে রুখে দাঁড়াতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তাদের সব দাবি বর্জনের ডাক দিতে হবে। তাদের সঙ্গে একদিকে আদর্শিক সংগ্রাম চালাতে হবে, অন্যদিকে সরকারের কর্তব্য তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এ দেশে যে জামায়াত-শিবিরের থাকারই কথা নয়, তারাই আজ সমাজে আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। শুধু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করে তাদের নির্মূল করা যাবে না। তাদের পালনভূমি ধ্বংস করতে হবে।

ক্ষমতার রাজনীতি দিয়ে তা সম্ভব নয়। এ জন্য মুক্তির রাজনীতিকে উঠে দাঁড়াতে হবে।ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা খাতুন বলেন, দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে গেছে তখন আন্দোলন তো করতে হবেই। এর পাশাপাশি নিজ নিজ ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক কাজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে সেই কাজগুলো করা হয়নি বলেই আজকের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেন, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ দেশকে জঙ্গলে পরিণত করেছে। এর বিরুদ্ধে শুধু রুখে দাঁড়ালে হবে না, ঘুরেও দাঁড়াতে হবে।

কারণ, পেছন থেকে ছুরি মারার মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়েছে।সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী সংঘবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে প্রতিরোধ সৃষ্টির কথা বলেন। রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব অজয় রায় বলেন, ‘হেরে যাওয়ার জন্য এই বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়নি। আমরা হারতে পারি না।’শিক্ষাবিদ ও লেখক অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানান।জামায়াত-শিবিরকে প্রচলিত আইনেই নিষিদ্ধ করা সম্ভব উল্লেখ করে আইনজীবী শাহ্দীন মালিক বলেন, ‘তারা রাজনীতি করে না। সমাজে আতঙ্ক ছড়ায়। সহিংসতা সৃষ্টি করে সাধারণ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের কাজ আইনসিদ্ধ নয়।’সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে আক্রান্ত নিগৃহীত সংখ্যালঘুদের পাশে রাজনীতিকেরা যান না। সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য সুশান্ত কুমার দাস বলেন, ‘সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়ে গুটিয়ে থাকলে লাভ হবে না। প্রতিরোধ করতে হবে। মরলে মেরে মরতে হবে।’সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, রাজনৈতিকভাবে জামায়াতকে এবং সামাজিকভাবে হেফাজতকে প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য তাদের কর্মসূচির বিকল্প কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকা দরকার।

এম এম আকাশ বলেন, যাঁরা একাত্তরের পেছনে যেতে চান না, তাঁদের পথে নামতে হবে। এবার একটা ফয়সালা করতেই হবে। না হলে দেশকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না।সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাংবাদিক আবেদ খান, আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত, কৃষিবিদ আবিদুর রেজা, নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক, নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির এবং গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারও বক্তব্য দেন। সম্মেলন সঞ্চালনা করেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মোহাম্মদ এ আরাফাত। কর্মসূচি: সম্মেলনে চারটি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এগুলো হচ্ছে জাতীয় সম্মেলনের ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর ও প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান (প্রধানমন্ত্রীর সময় পাওয়া সাপেক্ষে); গণজাগরণ মঞ্চসহ অভিন্ন দাবিতে সব নাগরিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে অংশগ্রহণ; সব বিভাগীয় সদরে নাগরিক সমাবেশের উদ্যোগ গ্রহণ এবং পাঁচ দফা দাবির সমর্থনে আলাদা আলাদা আলোচনা সভা ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করা।