ইচ্ছামতো সেবনে কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক

নির্বিচার ব্যবহারের কারণে অনেক অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কার্যকারিতা হারাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ কারণে রোগের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়ে চিকিৎসা-ব্যয় ১০ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে নিয়মনীতি কার্যকরে মোটেই তৎপর নয়। আছে সক্ষমতার অভাবও। বস্তুত অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে দেশে স্পষ্ট ও জোরদার কোনো প্রক্রিয়াই নেই, যা বিশেষজ্ঞদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ব্যাপারে সাধারণ সচেতনতার মাত্রাও দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে খুব নিচু। চাইলেই দোকান থেকে এজাতীয় ওষুধ কেনা যায়। গবেষকদের মতে, চিকিৎসকেরা রোগ নির্ণয়ের ঝামেলা এড়াতে ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক লিখছেন বা রোগীরাও দ্রুত সুস্থ হতে চিকিৎসককে প্রভাবিত করছেন। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে কয়েকটি অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারিয়েছে। এতে করে যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া ও টাইফয়েডের মতো রোগ দুরারোগ্য হয়ে উঠেছে।আইনের বাস্তবায়ন নেই: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকসহ চার ধরনের ওষুধ ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বিক্রি হবে না—এ ধরনের একটা উদ্যোগ একসময় নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। ঔষধ প্রশাসনও ঠিকমতো কাজ করে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার মো. সিফায়েতউল্লাহ বলেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে লোকবল বাড়িয়ে নজরদারির চেষ্টা চলছে। কিন্তু সর্বস্তরে সচেতনতা না বাড়লে হবে না। তিনি আরও বলেন, ফার্মাসিস্ট ও চিকিৎসক না থাকলে ওষুধের দোকানের অনুমোদন দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু এ আইন মানা হয় না, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এত জনবলও নেই।অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে নেপালে ২০০২ সালে মাত্র সাত সপ্তাহে পাঁচ হাজার ৯৬৩ জন জটিল টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়।এ ছাড়া যক্ষ্মা রোগীরা অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে অনিয়ম করায় দুরারোগ্য মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট (এমডিআর) টিবিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে যক্ষ্মার সাধারণ ওষুধে আর কাজ হয় না। এমডিআর রোগীও ঠিকমতো ওষুধ না খেলে তার হবে এক্সট্রিম ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি (এক্সডিআর-টিবি), যার কোনো চিকিৎসা নেই। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত এক কর্মশালায় বলা হয়েছে, জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী হয়ে গেলে যক্ষ্মার চিকিৎসার ব্যয় ২০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে, যা স্বাস্থ্যসেবার ওপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করবে।যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিকের বিপদ কী: অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি বা কম ব্যবহারে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলো টিকে যায় এবং শক্তি সঞ্চয় করে। অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, ওষুধের নিম্ন মান, ভুল মাত্রা, পুরো কোর্স শেষ না করা ইত্যাদি কারণে ওষুধ কার্যকারিতা হারায়। তাৎক্ষণিকভাবে এর কোনো প্রভাব পড়ে না। ওষুধ-প্রতিরোধী হয়ে ওঠা মারাত্মক জীবাণুটি রোগীর শরীর থেকে বেরিয়ে আশপাশের মানুষকেও আক্রান্ত করে। অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারালে কখনো কখনো রোগ সারে না, প্রায়ই রোগ সারতে বেশি সময় লাগে এবং এ কারণেই চিকিৎসা-ব্যয় বাড়ে। বর্তমান পরিস্থিতি: দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা নিয়ে বিস্তারিত কোনো গবেষণা নেই। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মাসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ ও ঔষধ প্রযুক্তি বিভাগ এবং যুক্তরাজ্যের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিভিশন অব সোশ্যাল রিসার্চ ইন মেডিসিন অ্যান্ড হেলথ যৌথভাবে ছয়টি জেলা হাসপাতালে একটি সমীক্ষা চালায়। দেখা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, ময়মনসিংহ, নড়াইল ও শেরপুরে শিশু, অস্ত্রোপচার এবং জেনারেল মেডিসিন বিভাগে ৯০ ভাগ রোগী এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছে। খুলনা হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের মাত্রা কিছুটা কম ছিল। অত্যধিক ব্যবহারের কারণে এসব এলাকায় সেফট্রিএক্সন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন এবং লেভোফ্লক্সাসিন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শতভাগ কাজ করছে না। নিউমোনিয়া, ব্যাকটেরিয়াজনিত মেনিনজাইটিস, টাইফয়েড ও গনোরিয়া রোগে অত্যন্ত কার্যকর ওষুধ হিসেবে সেফট্রিএক্সন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু শেরপুর, নড়াইল ও ফেনীতে এই ওষুধ ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে কাজ করছে না। হাতেগোনা দু-একটি রোগের চিকিৎসায় মাত্র ১০-২০ শতাংশ ক্ষেত্রে কাজ করছে বহুল ব্যবহূত সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও লেবোফ্লক্সাসিন। বাংলাদেশের জেলা হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার ও ওষুধ-প্রতিরোধী জীবাণুবিষয়ক এক সমীক্ষার প্রধান গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মাসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের শিক্ষক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দোকান থেকে যে-কেউ যেকোনো ধরনের ওষুধ কিনতে পারছে। এ ছাড়া তৃণমূলে ওষুধ বিতরণে কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। আজাদ চৌধুরী বলেন, ইউনিয়ন সাব সেন্টারে অনেক ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ক্যাপসুল, মলম বা ড্রপ বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য পাঠানো হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখানকার কর্মীরা ইচ্ছামতো ওষুধ দিয়ে থাকেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ২০১০ সালে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ওষুধের ব্যবহার নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। হু এতে বলেছে, দেশগুলোতে ৫০ শতাংশের বেশি ওষুধ ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই বিক্রি হয়। অর্ধেকের বেশি দেশ ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহারের মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করে না। করণীয়: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ২০০৫ সালে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের নির্দেশিকা প্রণয়ন করে। তবে চিকিৎসকেরা তা অনুসরণ করছেন কি না, সে সম্পর্কে কারও কোনো ধারণা নেই। এ ব্যাপারে সচেতনতা কার্যক্রমের সমন্বয়ক এবং বিএসএমএমইউর সহযোগী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান সরকারি উদ্যোগে স্বাস্থ্যবিধি প্রচারের তাগিদ দেন। তিনি জানান, ভারতে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা রক্ষায় ৭০টি ওষুধের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র থাকা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশেও অনুরূপ ব্যবস্থা চালুর ওপর জোর দেন তিনি। অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারানোর আগেই নতুন ওষুধ উদ্ভাবনের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে হু। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি সামান্য। বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মুক্তাদির বলেন, ‘সংক্রামক ব্যাধি মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্যা বলে উন্নত বিশ্ব নতুন ওষুধ উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছে না। তাই আপাতত আমাদের কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষসহ সব মহলকেই সচেতন হতে হবে।’