আজ বাবা দিবস। এ উপলক্ষে পাঠকের কাছ থেকে লেখা আহ্বান করেছিলাম আমরা। বাবাকে নিয়ে লিখেছেন ল্যাবএইড বিশেষায়িত হাসপাতালের জুনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সৈয়দা ফাইরুজ জাহেদী
শাড়ি পরে একটু সেজেগুজে কোথাও বের হতে গেলেই পাপা ডাক দিতেন, ‘মা, দাঁড়াও তো। একটা ছবি তুলে নিই।’ একটু রাগই লাগত। বলতাম, দেরি হচ্ছে তো, পরে ছবি তুলে তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে দেব। পাপা তবুও তুলতেন। এখন বুঝি, ওভাবে আর কোনো দিন কেউ এক সমুদ্র আদর ও আগ্রহ নিয়ে ছবি তুলতে চাইবে না। আমি এখনো সাজি; কিন্তু কেউ তোমার মতো যত্ন করে ছবি তোলে না পাপা।
একদম ছোট থেকেই বাবাকে পাপা ডাকি। ছোট্ট একটা শব্দ হলেও ডাকার জন্য সারাক্ষণ মন আকুল হয়ে থাকে। গত বছর তুমি হঠাৎ করেই আল্লাহর কাছে চলে গেলে। পাপা, তোমাকে ছাড়া কঠিন প্রতিকূলতার সাগরও পাড়ি দিচ্ছি, কিন্তু কীভাবে দিচ্ছি তা শুধু আমি আর আল্লাহ জানেন।
এসএসসির পর ফুপ্পি আমাকে সিডনি (অস্ট্রেলিয়া) নিয়ে যেতে চাইলেন। প্রক্রিয়াও শুরু হলো। সব ঠিকঠাক। তুমি হঠাৎ বাদ সাধলে। ‘একটা মাত্র মেয়ে আমার। ও চলে গেলে কী নিয়ে থাকব!’ তোমার ইচ্ছাতেই দেশে থেকে যেতে হলো। আর এখন যে তোমাকে ছাড়া নয় মাস কাটিয়ে দিলাম, তার কী হবে?
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখন আমি উচ্চমাধ্যমিকে পড়ি। সেদিন কি যেন একটা অনুষ্ঠান ছিল। ও হ্যাঁ, নতুন অধ্যক্ষকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আমরা কয়েকজন সহপাঠী সেখানে না গিয়ে কলেজের মাঠেই ঘোরাফেরা করছিলাম। এক শিক্ষকের কাছে ধরা পড়ার পর সবার বাবার ফোন নম্বর দিতে বললেন। বললেন, সবার নামে বিচার যাবে। সংগত কারণে সবাই ভয়ও পেল। আমি পাপাকে ঘটনা খুলে বললাম। তিনি শুধু জানতে চাইলেন, কলেজের বাইরে গিয়েছি কি না। এরপর পাপা সেই শিক্ষককে ফোন করে বলেছিলেন, ‘স্যার, এ রকম দুষ্টুমি আপনি আমি সবাই করেছি। বুকে হাত রেখে বলেন তো, ছাত্রজীবনে কখনোই ক্লাস মিস হয়নি কিংবা দুষ্টুমি করেননি। ওরা তো ক্লাস ফাঁকি দেয়নি। কলেজের বাইরেও যায়নি। আর ও রকম অনুষ্ঠানে বসে ভাষণ শুনতে কজনেরই বা ভালো লাগে?’ অভিভাবকের মুখে এসব শুনে স্যার অনেকটাই অবাক হয়েছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের দিন একে একে সবাইকে মঞ্চে ডাকা হচ্ছিল। আমি মঞ্চ থেকেই তাকিয়ে দেখলাম, ছলছল চোখে ভিডিও করছেন বাবা। নিচে এসে বললাম, ‘ধুর, ইমোশনাল হচ্ছো কেন? এটা তো সবাইকেই দিচ্ছে।’ পাপা খুব গর্বিত হয়ে জানান, ‘মেয়েকে এভাবে দেখাটাও তো স্বপ্নের মতো। তা ছাড়া সমাবর্তনের পরদিনই কতজনইবা চাকরিতে যোগ দিতে পারে?’ আমি তো আরও অনেক বড় হয়ে অনেকভাবে তোমাকে গর্বিত করতে চেয়েছিলাম, পাপা।
গত বছর ঈদের দিন আমার ডিউটি পড়ল। পাপা একটু অভিমান করেই বললেন, ‘এত ছোট বয়সেই আমার মেয়েটা দায়িত্ব নেওয়া শিখছে। মানুষের সেবা করছ, ঠিক আছে; কিন্তু বাসায় কোরবানি হবে, আয়োজন হবে, তোমাকে ছাড়া আমরা বুড়া–বুড়ি একা একা কী ঈদ করব?’ অথচ আমাদের জীবন থেকেই ঈদের আনন্দ চলে গেল। আমরা মা-মেয়ে হাসতে ভুলে গেলাম। মাকে দেখে রাখার এত বড় দায়িত্বও আজ আমার কাঁধে। ছোট্ট পৃথিবীতে তাঁরও আমি ছাড়া আর কেউ নাই...
মা-বাবা–মেয়ে মিলে আমাদের ছোট্ট পরিবার ছিল। দু-তিন দিনের ছুটি হলেই ছুটতাম সাগর পাড়ে। এটাতেই ছিল আমাদের রাজ্যের আনন্দ। পাপার সঙ্গে ম্যাচিং করে জামা নিতেও ভুলতাম না। এখন আর ম্যাচিং করতে চাই না পাপা। শুধু একমুহূর্ত কথা বলতে চাই।
পাপা ভালো রান্না জানতেন। করোনার সময় তো সবাই বাসায় অবসর সময় কাটাত। আমি রেসিপি দেখাতাম বা শুধু বলতাম, ‘পাপা এটা খাওয়াও, ওটা খেতে ইচ্ছা করছে।’ ঠিক সময়ে তিনি রান্না করে চমকে দিতেন। প্রস্তুতির সময়ও ডাকতেন না। কখনো কখনো সরাসরি হাঁড়িসহ আমার রুমে এসে বলতেন, ‘দেখো তো, কেমন হলো?’
বাবা আর আমার নামটাও এক—সৈয়দ হাসান জাহেদী, সৈয়দা ফাইরুজ জাহেদী। একই নামের মতো বাকি জীবনটা যেন তোমার মতোই নির্ভয়ে মাথা উঁচু করে, দয়ালু হৃদয় নিয়ে বাঁচতে পারি পাপা। আমাকে রেখে যাওয়ার জন্য একরাশ অভিমান নিয়ে বসে আছি। কীভাবে অভিমান ভাঙাবে, ভেবে রেখো কিন্তু...