পাহাড়ের প্রাণের উৎসব বৈসাবি

লেখাটি ২০২০ সালে ‘প্রথম আলো’র বিশেষ ম্যাগাজিন ‘বর্ণিল বৈশাখ’–এ প্রকাশিত হয়। সামান্য পরিমার্জন করে বৈসাবি উপলক্ষে আবার প্রকাশ করা হলো

বৈসাবি উৎসবে সরাসরি বাজনার সঙ্গে দলীয় নাচ পরিবেশন করছেন পাহাড়ি একদল তরুণ। ছবিটি ২০১৭ সালে খাগড়াছড়িতে তোলা
ছবি: পল্লব মোহাইমেন

পাহাড় থেকে সমতল একই আলোর রশ্মিতে প্রাণ জেগে ওঠে এই নীলচে গ্রহে। সূর্যের কক্ষপথ এক, একই আবর্তনে আসে নতুন ভোর, নতুন বছর। নতুন বছর মানেই নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা। আর সে কারণে সম্ভবত নতুন বছরকে বরণ করার উৎসব সব সময়, সব জনপদে, সব সংস্কৃতিতে একই রকম বর্ণিল, রঙিন। আমাদের সমতলেও যেমন নববর্ষের বর্ণাঢ্য উৎসব হয়, পাহাড়ও তার ব্যতিক্রম নয়। সবখানে নববর্ষের উৎসব হয় জাঁকালো।

ফুল ভাসিয়ে পুরান বছরকে বিদায় জানানোর আয়োজন চলছে। আজ তোলা ছবি

রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের অত্যুচ্চ পাহাড় আর গহিন অরণ্য, সে অরণ্য-পাহাড়ে বাস করা মানুষ এবং তাদের বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি মিলেই আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের সৌন্দর্য। সে সৌন্দর্যের মুকুটে রঙিন পালক বৈসাবি। মূলত ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বৈসুক, মারমা জনগোষ্ঠীর সাংগ্রাই এবং চাকমা জনগোষ্ঠীর বিঝু—এই তিন অনুষ্ঠান মিলে বৈসাবি। ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা এই তিন জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে এই তিন জনগোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান উৎসবকে একত্রে উদ্‌যাপন করার একটি রাষ্ট্রীয় প্রথা এই বৈসাবি। তবে বলে রাখা ভালো, বৈসাবি কিন্তু একক কোনো অনুষ্ঠান নয়। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ পার্বত্য অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠী নিজেদের সংস্কৃতি ও বিশ্বাস থেকে নববর্ষের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে জড়িত থাকে তাদের নিজেদের প্রথা ও সংস্কার। চৈত্র মাসের শেষ দুটি দিন এবং বৈশাখ মাসের প্রথম দিন এই তিন দিন অনুষ্ঠান পালন করে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রকৃতিই যে জীবনের উৎস, যাপনের বাহন, পার্বত্য অঞ্চলের আদি বাসিন্দারা সেটাকে অস্বীকার করেনি কখনো। আর সেটা করেনি বলেই এই জনগোষ্ঠীগুলোর প্রতিটি অনুষ্ঠানে প্রকৃতির ছোঁয়া থাকে স্বাভাবিকভাবে। এ জন্য বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিঝু অনুষ্ঠানে ফুলের ব্যবহার চোখে পড়বে উল্লেখযোগ্যভাবে। চোখে পড়বে প্রকৃতিপূজার বিভিন্ন প্রথা। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বৈসুকের প্রথম দিনের নাম হারি বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই অনুষ্ঠানের প্রথম দিনের অনুষ্ঠানের নাম সাংগ্রাই আক্যা বা পাইং ছোয়ায় এবং চাকমাদের বিঝুর প্রথম দিনের নাম ফুল বিঝু। প্রথম দিনগুলো মূলত ফুল সংগ্রহ, বাড়িঘরের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদিতে কাটানো হয়।

পাজন পরিবেশন করা হচ্ছে লেকের পাড়ে

দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু হয় খাওয়াদাওয়া, অতিথি আপ্যায়নের মূল পর্ব। নতুন বছর খাদ্য-পানীয়ের মহা উৎসব, সে পাহাড়ে হোক কিংবা সমতলে। এই খাবারের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন থাকে, তেমনি থাকে নতুন নতুন পদের খাবারও। আমরা পাজনের নাম জানি। এটি চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার। একসময় বলা হতো কমপক্ষে বাইশ পদের জিনিস দিয়ে পাজন রান্না করতে হবে। এই বাইশ পদের মধ্যে বেশির ভাগ থাকত ঋতুভিত্তিক সবজি ও শাক। আর থাকত শুঁটকি। বিভিন্ন ধরনের পিঠাও খাওয়া হয় এ সময়। বিন্নি চালের বড়া পিঠা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা—এই তিন জনগোষ্ঠীর অনুষ্ঠানের ধরন প্রায় একই রকম। তবে মারমা জনগোষ্ঠী নববর্ষে খেলে থাকে পানিখেলা। মূলত তরুণ-তরুণীদের অংশগ্রহণে এ পানিখেলা হয়। আর উল্লেখযোগ্যভাবে যা করা হয় তা হলো, প্রকৃতিকে সম্মান জানানো। চাকমারা বড় কোনো গাছ থাকলে তার নিচে প্রদীপ জ্বালিয়ে তাকে সম্মান প্রদর্শন করে জীবন ও প্রতিবেশকে রক্ষা করার জন্য। গৃহপালিত পশুদের বিশ্রাম দেওয়ার রেওয়াজও রয়েছে এদিন। বিঝু উৎসব চলাকালে কোনো জীবিত প্রাণী হত্যা করে না চাকমা সম্প্রদায়। এ সবকিছুই যেন প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ, প্রকৃতি রক্ষা ও তার কাছে ফিরে যাওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা।

উৎসবের সাজে পাহাড়ি নারী

পয়লা বৈশাখ ত্রিপুরা, মারমা, চাকমাসহ প্রতিটি সম্প্রদায় নিজ নিজ বিশ্বাস ও সংস্কার অনুসারে প্রার্থনা করে নতুন বছর যেন সুখে-শান্তিতে কেটে যায়। প্রার্থনা করে, প্রকৃতি যেন তাদের সহায়তা করে, ফসলের যেন ক্ষতি না হয়। ধনে-জনে যেন পূর্ণ হয়ে ওঠে প্রতিটি ঘর। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বর্তমানে খ্রিষ্ট ও বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে পড়েছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীর মানুষ। ফলে তাদের প্রথাগত জীবনাচরণে এসেছে পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে তাদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানেও। ফলে গির্জা ও প্যাগোডাকেন্দ্রিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখা যায় এখন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নববর্ষে।

মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরা মূলগতভাবে এই তিন জনগোষ্ঠী বৃহত্তর মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর রেওয়াজ বহু পুরোনো। খেয়াল করলে দেখা যাবে, তিব্বত থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্যন্ত নতুন বছর শুরু হয় বৈশাখ মাসে। এবং এই প্রথা নতুন নয়। এ অঞ্চলের কৃষিকেন্দ্রিক সংস্কৃতি রয়েছে এর মূলে। সে প্রাচীন প্রথাকে ধারণ করেই পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিটি জনগোষ্ঠী নিজেদের নববর্ষ পালন করে থাকে। জনপদ আর জনগোষ্ঠী যা–ই হোক, বৈসাবি আমাদের উৎসব। নতুন বছরে বৈসাবির প্রার্থনা ছড়িয়ে পড়ুক নীলচে পাহাড়ের বাইরে। আনন্দধারায় সিক্ত হোক সবাই।