বিখ্যাত মার্কিন গণিতবিদ জন জর্জ কেমেনি বলেছিলেন, ‘একজন শিক্ষকের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো ছাত্রদের এমনভাবে তৈরি করা, যেন তারা শিক্ষককেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।’ ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) প্রভাষক আকিব জামান কি সেই পথেই হাঁটছেন?
ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ (ইউআরসি) প্রতিযোগিতায় ২০২১ সালে প্রথম হয়েছিল বাংলাদেশের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি)। এমআইএসটির ছাত্র হিসেবে সে সময় দলে ছিলেন আকিব। প্রথম হয়েও একটু আফসোস ছিল বিজয়ীদের মনে। কারণ, করোনার কারণে সে বছর ইউআরসির আয়োজন হয়েছিল অনলাইনে, ছোট পরিসরে। সেই আফসোস ঘোচাতেই যেন উঠেপড়ে লেগেছেন আকিব।
ইউআইইউতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর তাঁর নেতৃত্বেই পরপর দুই বছর এশিয়ায় সেরা হলো বাংলাদেশ। বৈশ্বিকভাবে ২০২২ সালে ইউআইইউর অবস্থান ছিল ১৩তম। আর এ বছর নবম। সামনে নিশ্চয়ই আরও ভালো ফলের জন্য প্রস্তুতি নেবেন তাঁরা।
বিজ্ঞানীদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী কয়েক দশকের মধ্যে মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপন করতে যাচ্ছে মানুষ। কিন্তু সে জন্য চাই আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি রোভার, যেগুলো লাল গ্রহকে মানুষের বাসযোগ্য করতে সাহায্য করবে। এমন রোভার তৈরির কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যুক্ত করতেই আয়োজন করা হয় ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ (ইউআরসি)। নাসার অলাভজনক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান দ্য মার্স সোসাইটি এর আয়োজক।
এবারের আসরে ১৫টি দেশ থেকে ১০৪টি দল অংশ নেয়। প্রাথমিক বাছাই শেষে শীর্ষ ৩৭টি দলকে প্রতিযোগিতার মূল পর্বে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। ইউআরসি ২৩–এর চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয় ১ থেকে ৩ জুন, যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ অঙ্গরাজ্যের হ্যাঙ্কসভিল শহরের মার্স ডেজার্ট রিসার্চ স্টেশনে। বাংলাদেশ থেকে মোট ৪টি দল প্রতিযোগিতার ফাইনালে অংশ নেয়। সামগ্রিক র্যাঙ্কিংয়ে নবম এবং এশিয়ার দলগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ স্কোর করে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) দল ইউআইইউ মার্স রোভার।
বাংলাদেশের দলগুলোর মধ্যে এর পরের অবস্থানে আছে যথাক্রমে ব্র্যাকইউ মঙ্গলতরি (ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি), টিম ইন্টারপ্ল্যানেটার (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) এবং এমআইএসটি মঙ্গলবার্তা (মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি)।
আমাদের সঙ্গে যখন ইউআইইউ দলের যোগাযোগ হলো, তখনো তাঁরা দেশে পৌঁছাননি। অনলাইন আলাপে ৯ জুন আকিব জানালেন, ‘উপদেষ্টা বা পরামর্শক হওয়ার চেয়ে আমি দলের একজন সদস্য হিসেবেই কাজ করতে চেষ্টা করেছি। ওরা রাত জাগলে আমিও ওদের সঙ্গে রাত জেগেছি।’ তিনি মনে করেন, তাঁর তত্ত্বাবধানে শুধু দল উপকৃত হয়েছে, তা নয়। তিনি নিজেও দক্ষতা ঝালাই করার সুযোগ পেয়েছেন।
ইউআরসির চূড়ান্ত পর্বে দলগুলোকে চারটি চ্যালেঞ্জিং মিশনের (অথবা পরীক্ষার) মুখোমুখি হতে হয়—বিজ্ঞান, এক্সট্রিম ডেলিভারি, ইকুইপমেন্ট সার্ভিসিং ও অটোনোমাস নেভিগেশন। এসব মিশনের মাধ্যমে মঙ্গলের মাটি পরীক্ষা, মাটি ও শিলার নমুনা বিশ্লেষণ প্রভৃতি কাজে শিক্ষার্থীদের তৈরি রোবটের দক্ষতা যাচাই করা হয়েছে। এক্সট্রিম ডেলিভারি মিশনে সামগ্রিকভাবে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ইউআইইউ মার্স রোভার।
পরপর দুবার এশিয়ায় সেরা অবস্থান ধরে রাখতে পেরে ইউআইইউর শিক্ষার্থীরা বেশ খুশি। দলনেতা আবিদ হোসেইন বলছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের সব রকম সাহায্য করেছে। কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা তো ছিলই। আমরা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ল্যাব তৈরি করেছি, যেখানে রোভারের প্রতিটি সাব-সিস্টেম ও রোবোটিকস নিয়ে গবেষণার সুযোগ ছিল।’
ইউআইইউর রোভারটি মহাকাশ বা মঙ্গল গ্রহের জন্য তৈরি হলেও এই প্রযুক্তি দেশে কাজে লাগানোর সুযোগ আছে বলে মনে করেন দলের সদস্যরা। কৃষিক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়করণসহ পরিবেশ পর্যবেক্ষণ, প্রত্যন্ত অঞ্চলে জরিপ, দুর্যোগে ত্রাণসহায়তা পৌঁছানোর মতো কাজে ভূমিকা রাখতে সক্ষম এই রোবট।
জানতে চেয়েছিলাম ইউআইইউ মার্স রোভার দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। প্রভাষক আকিব জামান শুরুতেই মনে করিয়ে দিলেন, তাঁদের তৈরি রোবটটির নাম ‘টেলস’। গ্রিক এই শব্দের অর্থ—কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য পূরণ করা। কেন এই নামকরণ? আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার প্রশ্নে টেলস এলই–বা কেন?
আকিব বলেন, ‘গত বছর আমাদের লক্ষ্য ছিল নিজেদের চেনানো। কিন্তু এ বছর আমাদের স্বপ্ন ছিল আরও বড়। কার্যক্রমকে এমন উচ্চতায় নিতে চেয়েছি, যেন আমাদের একটা প্রসিদ্ধ ল্যাব থাকে, একটা দক্ষ দল সব সময় কাজ করে এবং বিশ্বের অন্য দলগুলো আমাদের সমীহ করে৷ এটাই আমাদের “টেলস”। সব সময় প্রথম হওয়াটা জরুরি নয়। তবে প্রতিপক্ষের সমীহ আদায় করতে হবে৷ আমরা সেটা পেরেছি। প্রাথমিক বাছাই বা সিস্টেম অ্যাকসেপ্টেন্স রিভিউয়ে আমরা ১০৪টি দলের মধ্যে সামগ্রিকভাবে চতুর্থ হয়েছিলাম। ফলে ফাইনাল মঞ্চে পৌঁছানোর আগেই সব বিচারক আমাদের নাম জানতেন। বড় বড় দলের সঙ্গে টক্কর দিয়েছি। হয়তো কিছু ভুলের জন্য নবম হয়েছি। তবে অন্যতম সেরা দল হিসেবে সমীহ করেছে সবাই৷’
প্রভাষক আকিব জামান (পরামর্শক), আবিদ হোসেইন (দলনেতা), টি এম আল আনাম (সহ–দলনেতা), আহমেদ জুনায়েদ (যন্ত্রকৌশল নেতা, যন্ত্রকৌশল ফেব্রিকেশন), মো. বদিউজ্জামান (যন্ত্রকৌশল নেতা, থ্রিডি ডিজাইন), আব্দুল্লাহ আল মাসুদ (সফটওয়্যার অ্যান্ড অটোনমাস নেতা), সরওয়ার হোসেইন (সফটওয়্যার অ্যান্ড অটোনমাস সদস্য), শেখ সাকিব হোসেন (সফটওয়্যার অ্যান্ড অটোনমাস সদস্য), সুরাইয়া আফরোজ (বিজ্ঞান সদস্য), শাহ মেহরাব হোসেন (ইলেকট্রিক্যাল নেতা) ও মো. ইয়াসিন (লজিস্টিক নেতা)।