‘৩০ বছর পর অলৌকিকভাবে বাবাকে খুঁজে পেয়েছি’

৩০ বছর পর হারিয়ে যাওয়া বাবাকে ফিরে পান যুক্তরাজ্যের তরুণী এপি এলিস।
ছবি: সংগৃহীত

সকালে লন্ডন শহরের ফাইভ গাইজ কোভেন্টের সামনের ফুটপাতে বসে ছিলেন হাড়–জিরজিরে এক বৃদ্ধ। গৃহহীন, হতদরিদ্র। খানিক দূরেই দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে মেয়েটি এগিয়ে গেলেন বৃদ্ধের কাছে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার নাম কি ওমর?’

লোকটি মাথা তুলে মেয়েটির দিকে তাকালেন। দুই সেকেন্ড অপেক্ষা করে মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ।

ব্যস, আর কোনো কথা না বলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন দুজন। এভাবেই দীর্ঘ ৩০ বছর পর হারিয়ে যাওয়া বাবাকে ফিরে পান যুক্তরাজ্যের তরুণী এপি এলিস।

বাবা–মেয়ের আলিঙ্গনের সেই মুহূর্ত পথচারীদের দৃষ্টি ছাড়া ধরা পড়েছে ৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপেও। খুব ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া বাবাকে ফিরে পাওয়ার গল্পটা বিবিসিকে শুনিয়েছেন এলিস।

এতগুলো বছর বাবাকে খুঁজে বেরিয়েছেন এলিস।

এলিস তখন একেবারেই শিশু। সবে হাঁটতে শিখেছেন। হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান তাঁর বাবা ওমর। সেটি ছিল ১৯৯৪ সাল। এরপর পেরিয়ে গেছে ৩০টি বছর। এতগুলো বছরের প্রতিটি মুহূর্তই বাবাকে খুঁজে বেরিয়েছে এলিসের দৃষ্টি। বাবা কাছে না থাকলেও তাঁর লেখা চিঠি, জন্মদিনের কার্ড এবং অনেক ছবি ছিল এলিসের আছে। সেগুলোই বাবাকে খোঁজার প্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি বলেন, ‘বোঝার পর থেকে বাবাকে পাইনি, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া সবকিছু আমাকে ভাবাত। একবার হলেও বাবাকে দেখতে ইচ্ছা করত।’

১৮তম জন্মদিনে এলিস সিদ্ধান্ত নেন, যেভাবেই হোক বাবাকে খুঁজে বের করবেন। যাঁরা ওমরকে চিনতেন, তাঁদের জিজ্ঞেস করতে শুরু করেন। কয়েকজন ধারণা দেন যে তাঁর বাবা সম্ভবত এখন গৃহহীন, রাস্তায় রাস্তায় থাকেন।

সঙ্গে সঙ্গেই গৃহহীনদের সহায়তা করে এমন দাতব্য সংস্থা ও কাউন্সিল এজেন্সিগুলোয় খোঁজ করতে শুরু করেন এলিস। তবে তথ্যের সুরক্ষার জন্য সেসব জায়গা থেকে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির তথ্য পাওয়া ছিল দুষ্কর। তবু চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন এলিস।

ভ্যাররাল পল-ওয়ালকট (বা থেকে প্রথম) ২০ মিনিটের মধ্যে খুঁজে দেন এলিসের বাবাকে

আপনি কি আমার বাবাকে চেনেন?

বছর দুই আগে নভেম্বর মাসে টেলিভিশনে বিবিসি লন্ডনের একটি বিশেষ আয়োজনে এলিসের চোখ আটকে যায়। টেলিভিশনের পর্দায় তিনি দেখেন, উত্তর লন্ডনের টটেনহামে ভ্যাররাল পল-ওয়ালকট নামের এক ব্যক্তির পরিচালনায় একদল স্বেচ্ছাসেবক সাইকেলে ঘুরে ঘুরে রাস্তায় ঘুমন্ত গৃহহীন মানুষদের খাবার ও অন্যান্য জিনিস বিতরণ করছেন।

সামান্য আশার আলো দেখতে পান এলিস। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পল-ওয়ালকটকে একটি বার্তা পাঠান তিনি। বাবার তথ্য দেয়ে লিখেন, ‘আপনি কি আমার বাবাকে চেনেন?’

এলিসের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পল সময় নিয়েছিলেন মাত্র ২০ মিনিট। এলিস বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যখন ২০ মিনিট পর তিনি লিখলেন, “হ্যাঁ, আমি আপনার বাবাকে চিনি।”’

এলিস আরও বলেন, ‘শুরুতে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু পরমুহূর্তেই নানা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করে। যেমন, বাবার সঙ্গে দেখা করে কী করব? শুরুতে কী বলব তাকে? ইত্যাদি ইত্যাদি... প্রতিমুহূর্তেই মনে হচ্ছিল, ৩০ বছর ধরে একজন কোথায় কীভাবে ছিলেন, তা জানা এক রকম আর তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কী হবে, সেটি হয়তো একেবারেই ভিন্ন কিছু।’

অন্যদিকে এলিসের বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওমরের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন পল। গিয়ে দেখেন, ফুটপাতের যে নির্দিষ্ট জায়গায় ওমরকে আগে দেখেছেন, এখনো তিনি সেখানেই আছেন।

পল বলেন, ‘কাছে গিয়ে কোনো সাহায্য লাগবে কি না জিজ্ঞেস করলে তাঁর সমস্যাগুলোর কথা আমাকে জানান ওমর। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আবার তাঁর কাছে যাই এবং জানাই যে তাঁর জন্য একটি সংবাদ আছে।

তাঁকে বলি, “মিকা (এলিসের ডাক নাম) নামে একজন আপনাকে দেখতে চান।” ওমর অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। তাঁর চোখ ভিজে উঠল। বললেন, “ও আমার মেয়ে।”

বাবাকে ফিরে পাওয়ার পুরো কৃতিত্ব পলকে দিতে চান এলিস

আপনার নাম কি ওমর?

ওমরের কণ্ঠস্বর মুঠোফোনে রেকর্ড করে এলিসকে পাঠান পল। তিন দশক পর বাবার কণ্ঠস্বর শুনতে পান এলিস। এভাবেই পিতা-কন্যার ভেতর এক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হয়ে ওঠেন পল। এলিস আসা অবধি ওমরের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন তিনি। এলিসের হয়ে ওমরকে অনুরোধ করেন, যেখানে আছেন, সেখানেই থাকতে। যেন এলিস এসে তাঁকে খুঁজে পান।

এলিস বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল, বাবা হয়তো থাকবেন না। ত্রিশ বছর হয়ে গেছে, তাই সত্যিই খুব বেশি আশা করিনি। ৩ নভেম্বর শেষ পর্যন্ত তাঁকে দেখে ঘাবড়ে যাই। বলি, “আপনার নাম কি ওমর?” তিনি বলেন, হ্যাঁ। আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরি। কী যে এক পরাবাস্তব অনুভূতি। তাঁকে অপরিচিত মনে হওয়া দূরে থাক, উল্টো মনে হয়েছে, তিনি আমার কত আপন! দিনের বাকিটা সময় আমরা পার্কে গেছি এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিয়েছি। তার কাছে আমি সবকিছু বলেছি। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে অলৌকিক।

বাবাকে ফিরে পাওয়ার পুরো কৃতিত্ব পলকে দিতে চান এলিস। লন্ডন শহরে কাউকে খুঁজে পেতে চাইলে, বিশেষ করে গৃহহীন কাউকে খুঁজতে হলে ভ্যাররাল পল–ওয়ালকটের সাহায্য নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এলিস বলেন, ‘আমার বিশ্বাস পলকে এক ঘণ্টা সময় দিলেই তিনি খুঁজে এনে দিতে পারবেন।’

সূত্র: বিবিসি