নাম ছিল মধুসূদন দে। সবাই ডাকতেন ‘মধুদা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কলাভবনের উত্তর-পূর্ব দিকে যে রেস্তোরাঁ, এই মধুদার নামেই তাঁর নাম হয়েছে। মধুদার রেস্তোরাঁ সবার কাছে এখন ‘মধুর ক্যান্টিন’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তান-পর্বে এখানে অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পরিকল্পনা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন আন্দোলনে ছাত্রদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মধুর ক্যান্টিন সেসব আন্দোলন আর সংগ্রাম-পরিকল্পনার সাক্ষী হয়ে আছে। কিন্তু কে এই মধুদা? এ সময়ের শিক্ষার্থীরা কি জানেন?
মধুদা ছিলেন একজন সাধারণ রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী। ইতিহাসের পাতায় কখনো কখনো সামান্য লোকও অসামান্য হয়ে ওঠে। মধুসূদন দে এমনই একজন। ১৯১৯ সালের এপ্রিলে তাঁর জন্ম। মধুসূদনের বাবা আদিত্যচন্দ্র খাবারের ব্যবসা করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আদিত্যচন্দ্র এ কাজ করতেন। ১৯৩৪ সালে ১৫ বছর বয়সে বাবার ব্যবসার কাজে সহায়তা করা শুরু করেন মধুসূদন।
আজ যেখানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শুরুর দিকে সেটিই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন। তার পাশেই ছিল পুলিশ ব্যারাক বা ছাউনি। পুরো ক্যাম্পাসজুড়েই ছিল এ রকম অনেক ব্যারাক। ব্রিটিশ সরকার ক্যাম্পাস থেকে সেগুলো সরিয়ে নিতে থাকে। ব্রিটিশ পুলিশের কাছ থেকে ছনের দুটি ঘর কিনে নেন আদিত্যচন্দ্র। কটিতে তিনি থাকতেন, অন্যটিতে চা-সিঙাড়া বিক্রি করতেন। মাঝেমধ্যে নিজ হাতে মিষ্টিও বানাতেন। ঘরটি তখন আদিত্যের রেস্তোরাঁ নামে পরিচিত ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের কৃতী ছাত্র ছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু। তিনি স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাউন্ডের এক প্রান্তে টিনের চালওয়ালা দর্মার ঘর, ভেতরে মলিনবর্ণ টেবিলের পাশে লম্বা ন্যাড়া টুল পাতা। এখানেই আমরা ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ করে থাকি, যেহেতু সারা তল্লাটে দ্বিতীয় কোনো চা-ঘর নেই। আদিত্যর ভোজ্যতালিকা অতি সীমিত, কোনো দিন তাঁর স্বহস্তে প্রস্তুত মিষ্টান্ন ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না আমাদের।’
১৯৩৯ সালে আদিত্যচন্দ্র পক্ষাঘাতে মারা যান। মধুসূদনের ওপর গিয়ে পড়ে ব্যবসার ভার। প্রথম কিছুদিন বাবার আমলের ছনের ঘরেই ব্যবসা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বর্তমান ভবনে আসেন। আসলে হয়েছিল কী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই সময়ে ক্যাম্পাসে একটি ক্যান্টিনের প্রয়োজন বোধ করে। ইটের তৈরি এই একতলা ভবনটি তখন মধুসূদন দেকে দেওয়া হয়। একসময়ে এটি ছিল বাগানবাড়ির নাচঘর। নবাবদের মনোরঞ্জনের জন্য এখানে বাইজি–নাচ হতো। এখনো ভবনের দুদিকে দুটি সাজঘর রয়েছে। ১৯০৪ সাল পর্যন্ত ঢাকার নবাবরা এটিকে ‘দরবার হল’ বা বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহার করতেন। ১৯০৬ সালে এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ।
বিভিন্ন স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, সকালের দিকে মধুদা ক্যান্টিনে বসতেন না। সাধারণত দুপুরের পরে এসে তিনি ক্যাশে বসতেন। এসেই কর্মচারীদের জিজ্ঞাসা করতেন, ‘আইজকা মোয়াজ্জেম সাব আইছিল?’ মধুদার কথায় ছিল ঢাকাইয়া টান।
তাঁর লোকেরা বলতেন, ‘হ।’
তিনি বলতেন, ‘লেখো বিশ কাপ চা।...জাফর সাব?’
‘হ।’
‘লেখো পনেরো কাপ।’
সব ছাত্রনেতাই মধুর ক্যান্টিনে বসে রাজনৈতিক কাজকর্ম চালাতেন। আর মধুদা এভাবে বাকির খাতায় লিখে রাখতেন। কিন্তু কারা যে কয় কাপ চা খেতেন, তা যেমন ছাত্রনেতাদের জানা থাকত না, মধুদাও আসলে জানতেন না। অনুমান করে একেকটি সংখ্যা লিখে রাখতেন। আহমদ ছফা এই স্মৃতি উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘টাকাটা আদায় হতো কি না, আমার সন্দেহ।’
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘একদিকে শিক্ষার্থীদের জন্য মধুর ভালোবাসা আর অন্যদিকে মধুর প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা—এসব কিছু পাকিস্তানিদের কাছে মধুকে সন্দেহভাজন করে তুলেছিল।’ তা ছাড়া পাকিস্তান আমলে বহু আন্দোলন-সংগ্রামের সূচনাবিন্দু হিসেবে কাজ করেছে এই মধুর ক্যান্টিন। ফলে, পাকিস্তান মিলিটারি ১৯৭১ সালের মার্চে অপারেশন সার্চলাইট নামে যে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তার বলি হন মধুসূদন দে ও তাঁর পরিবার। পাকিস্তানি সেনারা ২৫ মার্চের ভয়াল রাতের পরদিন সকালে আক্রমণ করে জগন্নাথ হলের পাশের শিববাড়িতে। মধুদা পরিবার-পরিজন নিয়ে শিববাড়ি কোয়ার্টারে থাকতেন। সেনারা সেখান থেকে তাঁকে বের করে নিয়ে এসে গুলি চালায়। স্বামীকে বাঁচাতে এসে স্ত্রীও মারা যান। সেদিন মধুদার পুত্র আর পুত্রবধূও সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারান।
মধুর ক্যান্টিনের সামনে মধুসূদন দের একটি ভাস্কর্য আছে। সেখানে লেখা আছে, ‘আমাদের প্রিয় মধুদা’।