ফিলিস্তিনের জন্য কার্টুন

এ রকম প্রদর্শনী আমাদের ভেতর টিমটিম করে জ্বলতে থাকা আশার প্রদীপটাকে নিভতে দেয় না

মৃত ছোট্ট সন্তানটি আপাদমস্তক ব্যান্ডেজে মোড়ানো। সেই ব্যান্ডেজ থেকে চুইয়ে চুইয়ে বের হয়ে আসছে রক্ত। বাবা সেই মৃত সন্তানকে এমনভাবে রক্ষা করছেন, যাতে সেই লাশ নতুন করে ছিন্নভিন্ন না হয়ে যায়। একদিকে বাবা তাঁর মৃত সন্তানকে উদ্দেশ করে বলছে, ‘তোমার কিছুই হবে না। আমি আছি তো।’ আর দেখা যাচ্ছে, সেই বাবার শরীরের ওপর বিশাল একটি ইসরায়েলি সেনার পা। চারপাশ থেকে ছুটে আসছে গ্রেনেড। অর্থাৎ কয়েক সেকেন্ড পরের (কাল্পনিক) দৃশ্যটাই হলো, ছিন্নভিন্ন হয়ে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই বাবা আর মৃত সন্তানের লাশ!

কার্টুনটা দেখতে একটু সময় লাগল। কেননা যিনি কার্টুনটির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি সরছিলেনই না। মনে হচ্ছিল সরবেনও না। মুখে হাত দিয়ে একনাগাড়ে তাকিয়ে ছিলেন কার্টুনটির দিকে। বাধ্য হয়েই বললাম, ‘এক্সকিউজ মি।’ তরুণীটি থতমত খেয়ে বললেন, ‘সরি, আসলে সরে যে দাঁড়াব, মনে হচ্ছিল নড়তে পারছি না। এত মন খারাপ হলো।’

গতকাল শেষ হয়ে গেল কার্টুন ফর ফিলিস্তিন শিরোনামে চার দিনের প্রদর্শনী

একটা কার্টুন নিয়ে চলছিল আলোচনা। যমদূতও মানুষের জান নিতে নিতে ক্লান্ত। সে ইসরায়েলের সেনাদের কাছে একটা ‘ডে অফ’ ভিক্ষা চাচ্ছে। আরেকটা কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, আগুন ধরেছে প্যালেস্টাইনের তাঁবুতে। আশপাশে সৌদি আরব, মিসর, ইরাক, ইরান, ইয়েমেন, ওমান, তুরস্ক, ব্রুনেই সবাই ঘুমাচ্ছে। সৌদি আরব বলছে, ‘আমাদের কিছু হবে না, আমাদের গায়ে কোনো আঁচ লাগবে না। সবাই আরামে ঘুমাও।’ এদিকে আরেকটা কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা গণমাধ্যম একটা শক্ত, শক্তিশালী শেলের ভেতর ঢুকে পড়েছে। তীব্র আর্তনাদ, নিন্দা, পচা ডিম—কোনোকিছুই তাদের স্পর্শ করতে পারছে না।


একটা কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, মা শিশুকে গ্রেনেড খাওয়াচ্ছে। সেই শিশুর আবার দুটো পা নেই। সেখানে ব্যান্ডেজ করা। গ্রেনেড ছাড়া যে আর খাওয়ার কিছুই নেই! ‘কার্টুন ফর ফিলিস্তিন’ শিরোনামে ১১ নভেম্বর রাজধানীর দৃক গ্যালারিতে শুরু হওয়া কার্টুনের প্রদর্শনী শেষ হয়ে গেল ১৪ নভেম্বর। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান। প্রদর্শনীতে আহসান হাবীব, মেহেদী হকের মতো প্রতিষ্ঠিত কার্টুনিস্টদের সঙ্গেই স্থান পেয়েছে অপেশাদার একেবারেই তরুণ কার্টুনিস্টদের আঁকা।

এখানে আগত দর্শকেরা লিখেছেন তাঁদের অনুভূতি

দর্শকদের অনেকেই বলেছেন, নাম না দেখলে কোনটা যে পেশাদার আর কোনটা অপেশাদার শিল্পীর আঁকা, বোঝা দায়! আর এটিকেই এই প্রদর্শনীর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হিসেবে দেখছেন আলোকচিত্রী ও গ্রাফিক ডিজাইনার লতিফ হুসাইন। তিনি বললেন, ‘ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি সহিংসতার ইতিহাস বহু পুরোনো। সেই ইতিহাসের অসংখ্য অধ্যায় লেখা হয়েছে ফিলিস্তিনের হাজারো বেসামরিক মানুষের রক্তে। এ রকম চরম অন্যায় দেখে, শুনে, বুঝেও বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ, সংস্থা আর মানুষেরা যেভাবে নিজেদের স্বার্থে ইসরায়েলের গণহত্যার পক্ষ নিচ্ছে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো যেভাবে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে, সেই অসহায় হাহাকারে একটু হলেও সান্ত্বনা মিলল এই প্রদর্শনী দেখতে এসে। ফিলিস্তিনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড আমাদের তরুণ প্রজন্মের কার্টুনিস্টদের যেভাবে মানবিকভাবে স্পর্শ করেছে, এটা এ রকম কঠিন মুহূর্তেও আমার ভেতরে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা আশার প্রদীপটাকে নিভতে দেয় না।’

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি সহিংসতার ৭৫ বছরের ইতিহাসের অসংখ্য অধ্যায় লেখা হয়েছে ফিলিস্তিনের হাজারো বেসামরিক মানুষের রক্তে

বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট অ্যাসোসিয়েশন ও দৃক পিকচার লাইব্রেরির আয়োজনে এই কার্টুন প্রদর্শনীর পাশে স্থান পেয়েছে নাজি আল-আলির বিশ্বখ্যাত কিছু কার্টুন। নাজি সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র কার্টুনিস্ট, যাঁকে রাজনৈতিক কার্টুন আঁকার জন্য তাঁর কর্মক্ষেত্র আল কাবাসের লন্ডন দপ্তরের নিচে রাস্তায় খুব কাছ থেকে ঘাড়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর আগে তাঁকে একাধিকবার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তবে তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন, কার্টুনের মাধ্যমে যে বার্তা তিনি দিতে চান, সেটার সঙ্গে আপস করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

এই দেয়ালে ঝোলানো কার্টুনগুলো নাজি আল-আলির আঁকা, বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত

নাজির কার্টুনের মুখ্য চরিত্র হানদালা, যার অর্থ ‘তিক্ততা’। হানদালা ১০ বছরের এক শিশু, ছেঁড়া জামাকাপড় পরা, চুলগুলো সজারুর কাঁটার মতো। এই হানদালার মধ্য দিয়ে নাজি নাকি নিজেকেই এঁকেছেন, যে ১০ বছর বয়সে নিজের দেশ ফিলিস্তিন ছেড়ে দক্ষিণ লেবাননে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। আমৃত্যু তিনি কেবল নিজের গ্রামে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। হানদালা এমন এক বালক, যে জীবনে অনেক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। আমরা কোনো কার্টুনে তাঁর চেহারা দেখতে পাই না। সমস্ত পৃথিবী থেকে তার মুখ ফেরানো, অভিমানে, হতাশায়। যেন যে পৃথিবী তার কাছ থেকে তার জন্মস্থান কেড়ে নিয়েছে, তাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে, সেই পৃথিবীর কাছ থেকে তার নতুন করে কিছু চাওয়ার নেই। সে তাই মুখ ঘুরিয়ে পেছন দিকে হাত রেখে নীরবে সবকিছু দেখছে।

নাজি আল-আলি, তাঁকে আরব বিশ্বের সর্বকালের সেরা কার্টুনিস্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়

এই হানদালা ক্রমেই হয়ে ওঠে মানুষের বিবেকের প্রতিনিধি। নাজি কার্টুনের মাধ্যমে মানুষকে হাসাতে চাইতেন না, মানুষকে ভাবাতে চাইতেন, তাঁর কার্টুন দেখে মানুষ যেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, সেটি চাইতেন। আর সেই একই উদ্দেশ্যে, ফিলিস্তিনের নির্বিচার গণহত্যার প্রতিবাদে, সেই নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা নিয়ে ‘কার্টুন ফর ফিলিস্তিন’ শিরোনামে হয়ে গেল প্রদর্শনী।
 
প্রদর্শনীর এক পাশে রাখা এক ফালি তরমুজ। ফিলিস্তিনের পতাকার রঙের সঙ্গে মিলে যায় তার রং। লাল, সবুজ, সাদা, কালো। ১৯৬৭ সালের ‘সিক্স ডে ওয়ার’–এর পর ইসরায়েলি সেনাদের অধীনে চলে আসে গাজা। সে সময় গাজায় প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনের পতাকা রাখা নিষিদ্ধ ছিল। সেই আইনের বিরোধিতা করে গাজার অনেকেই তখন তরমুজ ফালি করে কেটে প্রকাশ্যে রেখে দিত। এটা ছিল নীরব বিদ্রোহ। এভাবেই একসময় ফালি করে কেটে রাখা তরমুজ নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রতীকে পরিণত হয়।

ফালি করে কেটে রাখা তরমুজ নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রতীকে পরিণত হয়

তরমুজের সবুজ ফিলিস্তিনের সবুজ মাঠ, ভূমির প্রতীক। কালো রং ফিলিস্তিনের অন্ধকার অতীতের প্রতীক। লাল স্বাধীনতার জন্য ফিলিস্তিনের মানুষের রক্তের প্রতীক। আর সাদা শান্তির প্রতীক। যে শান্তির প্রতীক সাদা রঙের পাখিটাকে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার মতো ক্ষমতাধর বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কেরা অনেক আগেই জবাই করে ফেলেছেন! সেই সত্যটাই উঠে এসেছে প্রদর্শনীতে ঝুলতে থাকা আরাফাত করিমের আঁকা কার্টুনে। কার্টুন মাধ্যমটাই যে এ রকম, মিনিমালিস্টিক আর্ট, সবচেয়ে অল্পতে সবচেয়ে বেশি, সবচেয়ে গভীরভাবে বলে ফেলার, প্রকাশ করার মাধ্যম!