ভুট্টার গাছগুলো রোদে শুকিয়ে মাচাতেই গাদা করে রাখা ছিল। রান্নার জ্বালানি। একদিন তারই কয়েকটা নামানোর জন্য যেই না গাদায় হাত দিয়েছেন, অমনি একটা বিষধর সাপ কামড়ে দিল। তারপর? চুয়াডাঙ্গার গৃহবধূ রতনা খাতুনের মুখে সেই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তের গল্প শুনলেন শাহ আলম
ছয় বছর আগের একদিন। বিকেল। বাড়িতে আমি আর আমার শাশুড়ি। পরদিনই রোজা শুরু হবে। তাই ঘরদোর গুছিয়ে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
বর্ষার দিনগুলো বাদে রান্নাবান্না আমরা উঠানেই করি। সেখানেই চুলা। চুলায় হাঁড়ি বসিয়ে পাশের মাচা থেকে শুকনা ভুট্টাগাছ আনতে গিয়েছিলাম। গাদায় বাঁ হাত ঢুকিয়েই মনে হলো, কী যেন একটা কামড়ে দিল, অনেকটা খোঁচা লাগার মতো। হাতটা বের করে আনতেই বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো সারা শরীরে একটা ঝাঁকি দিল। এর পর থেকে হাতে তীব্র ব্যথা শুরু হলো। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন শিরার ভেতরে মরিচের গুঁড়া ঢুকিয়ে দিচ্ছে। হাত জ্বলেপুড়ে যেতে থাকল। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সিরিঞ্জের সুচের মতো সাপের দাঁত ফুটে আছে। ভয় আর আতঙ্কে আমি চিৎকার করে উঠলাম।
চিৎকার শুনে ঘর থেকে আমার শাশুড়ি ছুটে এলেন। একজন প্রতিবেশীও এলেন। তাঁদের বললাম, আমাকে মনে হয় বিষধর সাপে কেটেছে। গরমের সময় বাড়িতে সাপ আসে। আগেও একাধিকবার দেখেছি।
আমার বাঁ হাতে কামড়ানোর চিহ্ন দেখে তড়িঘড়ি তাঁরা কবজির ওপর গামছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলেন।
সাপে কাটার খবর ছড়িয়ে পড়ে। একে একে আশপাশের লোকজন আসতে থাকেন। একেকজন একেক কথা বলেন। কেউ আবার ‘ভয়ের কিছু নেই, ইঁদুর কামড় দিয়েছে’ বলে অভয় দেন। কথাটার সত্যতা প্রমাণের জন্য ভুট্টাগাছের গাদায় ইঁদুর আবিষ্কারেও নেমে পড়েন তাঁরা। যতই বলি, আমাকে সাপে কামড়েছে, আমার কথা তাঁরা অগ্রাহ্য করতে থাকেন। কেউ কেউ ক্ষতস্থানে রক্তের রং কেমন, সেখানে কী ধরনের দাঁতের চিহ্ন আছে, খুঁজতে থাকেন। কেউ কাঁচা মরিচ, আবার কেউ তেঁতুল খেতে বলেন, বিষধর সাপ কামড়ালে নাকি এসব মিষ্টি লাগে।
আমার এদিকে জান যাওয়ার দশা, হাত জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে, আর ওদিকে যে যাঁর মতো ডাক্তারি-কবিরাজি করে সময় নষ্ট করতে থাকেন। এরই মধ্যে আমার স্বামী সাইফুল ইসলাম চলে আসেন। সব শুনে কবিরাজের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথায় আপত্তি করে সদর হাসপাতালে নিয়ে যান।
হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা সাপের ধরন সম্পর্কে জানতে চান। যে সাপ কামড় দিয়েছে, তা দেখতে কেমন, সেটি বিষধর নাকি নির্বিষ, বোঝার চেষ্টা করেন। পরে শুনেছি, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার জন্য নাকি সাপ চিনতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, একেক সাপের একেক রকমের উপসর্গ। তাই সাপের কামড়ের ধরন দেখে তা বিষধর, নাকি নির্বিষ বোঝা খুবই কঠিন।
হাসপাতালে আমার সামনেই চিকিৎসকেরা একে অপরের সঙ্গে সলাপরামর্শ করতে থাকেন। বিষধর সাপের কামড় খাওয়া রোগীর মাথা ঘোরা, মাথা হেলে পড়া, চোখের পাতা খুলতে না পারা, নাকি সুরে কথা বলা, শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যাসহ নানা সমস্যা হয়ে থাকে। সমস্যাগুলোর প্রায় সবই আমার ছিল। তাই সাপের বর্ণনা দিতে না পারলেও পরিস্থিতি বুঝে চিকিৎসকেরা আমার শরীরে সাপের বিষের ইনজেকশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শুরু হয় চিকিৎসা।
সাপের কামড় খাওয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসা শেষ হওয়া পর্যন্ত শরীর নিস্তেজ হয়ে গেলেও আমার কান ছিল সচল। কে কী বলছেন, তার প্রায় সবই শুনছি। কিন্তু একটা সময় কথা বলার মতো তেমন শক্তি ছিল না। চিকিৎসকদের শুধু জিজ্ঞাসা করেছি, আমি বাঁচব তো? কোনো সমস্যা হবে না তো? আমার মেয়েটার জন্য তখন খুব কষ্ট হচ্ছিল।
ইনজেকশন দেওয়ার ঘণ্টাখানেক পর থেকে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যায়। চিকিৎসকেরা পরদিন পুরোপুরি বিষমুক্ত ঘোষণা করেন। আমি বাড়ির পথে রওনা দিই।
যে রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তের কথা ভাবলে এখনো আপনি আঁতকে ওঠেন, নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হয় সেই বেঁচে ফেরাটা। জীবনের এমন পিলে চমকানো ঘটনার কথাই লিখে পাঠান আমাদের।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা: ছুটির দিনে, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০-২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫।
অথবা, ই-মেইল: chutirdine@prothomalo.com
*খামের ওপর ও ই-মেইলের subject–এ লিখুন ‘বাস্তবের রুদ্ধশ্বাস কাহিনি’