ঈদের আগের দিনগুলোর আলাদা কোনো নাম নেই। এসব দিনকে আসলে নাম দিয়ে ঠিক আটকে রাখা যায় না। এমন দিনে কোত্থেকে যেন একটা হু হু হাওয়া বুকের ভেতর ঢুকে মুহূর্তেই সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে যায়। ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেই কোথায়, শত শত মাইল দূর। নিমেষেই উবে যেতে থাকে বুকের চিনচিনে ব্যথা। উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতে থাকে বাড়ি ফেরার পথে জ্বলে ওঠা টিমটিমে আলো।
বাড়ি ফেরা! হ্যাঁ, ছুটি পেলেই এই চাওয়ার সামনে নত হয়ে থাকতে হয় মন। যেন নত হয়ে থাকাটাই এখানে নিয়ম। স্বপ্নের মতো। ছুটি পেলেই বুকের ভেতর যে হাওয়া ঢুকে পড়ে, সবকিছু এলোমেলো করার আগে ওই হাওয়াই কানে কানে দিয়ে যায় ডিঙা ভাসিয়ে সাগরপাড়ির মন্ত্র। বলে, বাড়ি চল মন, বাড়ি চল। সে কারণেই তো বাস-ট্রেন-লঞ্চ-বিমানের টিকিট নেই রবের মধ্যে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে টিকিট জোগাড় করতে হয়। কেউ কেউ বাস-ট্রেন-লঞ্চের ছাদে কোনোমতে দাঁড়ানোর জায়গা পান। তারপর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ভোরবেলা ঠিক ঠিক পৌঁছে যান স্বপ্নের স্টেশনে। সেখান থেকে বাড়ি। যেখানে পৃথিবীর শীতল হাওয়া নিয়ে অপেক্ষায় আছেন মা-বাবাসহ আরও কত প্রিয় মুখ।
এতক্ষণ যে কথাগুলো বললাম, তা কি কেবল আমার একার কথা? এসব কি আমাদের সবার কথা নয়! ঈদ-পার্বণে এমন ছুটি পেয়ে আমরা কি সবাই বাড়ি ফিরতে চাই না? প্রতি ছুটিতেই তো বাড়ি ফেরার আনন্দে দীর্ঘ পথের নকশা সবার ঠোঁটস্থ থাকে। বাড়ি ফেরার এই পথও যে কতটা দুর্গম হতে পারে, ঈদের ছুটি না এলে তা কি আমরা বুঝতে পারতাম? এ কারণেই হয়তো ৮ ঘণ্টার পথ ৩৬ ঘণ্টায়ও পৌঁছাতে না পারার নাম বাড়ি ফেরা। পথের মধ্যে থাকলে অতটা টের পাওয়া যায় না। কিন্তু বাড়ি পৌঁছে পেছনের এই ভ্রমণের কথা ভাবলে বিস্ময় জাগে, কী করে পেরিয়ে এলাম এই আগুনমাখা পথ! কেনই-বা এলাম?
এত ঝুঁকি-ঝক্কি সামলিয়ে কেন বাড়ি ফেরা? এর জবাবে প্রায় সবাই বলবেন, নাড়ির টানে, শিকড়ের টানে। এই নাড়ি বা শিকড় কি মা-বাবা? অন্য কিছু হোক বা না হোক, ঘুরপথে ঝক্কি নিয়ে বাড়ি ফেরা তো ওই মা-বাবার টানেই। এ কারণেই তো ছুটি হলেই মা-বাবা, ভাই-বোনদের কাছে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে ওঠে মন। ঠিক একইভাবে তাঁদের মনও কি আমাদের দেখার জন্য উতলা হয় না? হয়, তবে তাঁদের অন্য বাড়ি নেই। তাই তাঁদের কোনো ফেরা নেই। থাকে শুধু আমাদের ফেরার অপেক্ষা। এই শিকড় মানে তাহলে তো শুধু মা-বাবা, ভাই-বোন নয়। আছে ঘরও। তাহলে বছরে দুবার এত মায়া নিয়ে ফিরছি আসলে কোথায়? টিকিট না পেয়ে বাস-ট্রেনের ছাদে বসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাত্র তিন থেকে চার দিনের জন্য কোথায় যাচ্ছি আমরা?
ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী ফুয়াদ (ছদ্মনাম) এক ঈদে ছুটি পান। এবার ঈদেও পেয়েছেন। পরিবার নিয়ে ঈদ করতে রংপুরে গ্রামের বাড়িতে যাবেন। জানতে চাই, কিসের টানে যাচ্ছেন? ফুয়াদের জবাব, মা-বাবার টানে। ভাই-বোনদের টানে। ঘরের টানে।
‘ছুটি পাই আর না পাই, ঈদের সময় বাড়ি যাওয়ার জন্য মন আনচান করে। যে ঈদে বাড়ি যেতে পারি না, সে ঈদে কান্না আসে। কোনো কাজে মন বসে না। মন পড়ে থাকে সেই টিনের চালের ঘরে। মন পড়ে থাকে মা-বাবার কথা পেরিয়ে আসা জর্দা-পানের সুখী সুখী ঘ্রাণে। যত দিন মা-বাবা থাকবেন, ঈদে ছুটি পেলে অবশ্যই বাড়ি যেতে হবে। হোক দীর্ঘ পথ, থাকুক হাজার ঝক্কি। তবু বাড়ি যাওয়ার পথে যানজটে আটকে থাকার সময় স্বজনদের মুখ, বাড়ির যে স্মৃতি এসে ভিড় করে তার জন্য হলেও বাড়ি যেতে হবে,’ এভাবে ঈদে বাড়ি ফেরার কথা বলেছেন ফুয়াদ। তাঁর কাছে শিকড় মানে মা-বাবা, ঘর, স্বজনের মুখ। বাস থেকে নেমে ঢাল বেয়ে বাড়ি যাওয়ার সরু সিঁথিপথ। বাড়ি ফেরা মানে এসবের কাছেই ফিরছেন ফুয়াদ।
কিন্তু যাঁদের মা-বাবা নেই? তাঁরা কি ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরেন না? অবশ্যই ফেরেন। তাঁরা তবে কিসের টানে ফেরেন?
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাদিকুর রহমানের (ছদ্মনাম) মা-বাবা নেই। আট বছর আগে কয়েক মাসের ব্যবধানে বার্ধক্যের কারণে দুজনেরই মৃত্যু হয়। ভাই-বোনেরাও আলাদা হয়ে গেছেন। সবাই আলাদা জায়গায়, আলাদা বাড়িতে থাকেন। এরপরও বছরে দুই ঈদে নিয়ম করে পরিবার নিয়ে লঞ্চে করে বাড়ি যান সাদিকুর।
বাড়িতে তো আর কেউ-ই নেই, তাহলে কিসের টানে এত ঝামেলা পেরিয়ে বাড়ি যান? জবাবে সাদিকুর বলেন, ‘ওই বাড়িতেই তো আমার নাড়ি পোঁতা। সেই নাড়ির টানে যাই, যেতে হয়। মা-বাবা শুয়ে আছেন যে মাটিতে, সেই মাটির মায়ায় যেতে হয়। এমন না যে বাড়ি গিয়ে খুব ঘোরাফেরা করি। বরং ঘরদোর দেখাশোনা করি। ভাইদের সঙ্গে একবার দেখা করি। এরপর প্রায় সারা দিন ঘরের দাওয়ায় স্মৃতির পৃষ্ঠা খুলে বসি। নিজেকে দেখি, নিজেদের দেখি। এতে কষ্ট হালকা হয়ে আসে কিছুটা। কেউ নেই তবু বাড়িতে এলে শান্তি পাই, আনন্দ জাগে। মনে হয়, আমি ভালো আছি।’
তার মানে বাড়ি ফেরার মূল কারণটা রহস্যই থেকে যাচ্ছে। একেকজন একেক ভাবনা নিয়ে বাড়ি যান, যাচ্ছেন। তবে যে ম্যাজিক সবাইকে এক সূত্রে গেঁথেছে, তা হলো স্মৃতিস্মরণি। যাঁরা ঈদে বাড়ি ফিরছেন, অন্য অনেক কারণের মধ্যে তাঁদের কারণটা এক যে আনমনে তাঁরা কেউ স্মৃতি জমাতে আর কেউ স্মৃতি রোমন্থনে যাচ্ছেন।
ঈদ উপলক্ষে বছরে অন্তত একবার নতুন জামা ও নতুন জুতা কেনার সুযোগ আসে। কিন্তু সেই সুযোগ তো আর সবার হয় না। কারও কারও হয়। কেউ কেউ হয়তো পুরোনো জুতা রং করে নিয়েছেন। এখন চকচক করছে। কেউ হয়তো গত ঈদে কেনা পাঞ্জাবিটা আলমারিতে তুলে রেখেছিলেন। এবার সেটাই বের করে ইস্তিরি করে নিয়েছেন ঈদের দিন পরবেন বলে। এতে একটু-আধটু মন খারাপ হলেও প্রতিবার যে বিষয়ের কোনো হেরফের হয় না তা হলো, বাড়ি ফেরার অপেক্ষা।
এই অপেক্ষা পেরিয়ে বাড়ি ফিরে একটু দূর থেকে দেখি, সেই কবে বাড়িতে রেখে যাওয়া আরেকটি বয়সের আমি, বাবার হাত ধরে ঈদের কেনাকাটায় যাওয়া হাফপ্যান্ট পরা আমি তাকিয়ে আছে এই আমির দিকে। এই চোখে দেখি তার টলটলে চোখ। দুজনের চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে একই পৃথিবীর রং। চোখ বুজে আলতো করে তার চুলে বিলি কেটে দেখি হেসে উঠছে দুজনের বুকের জখম। তাহলে এবার বলুন, ছুটিতে বাড়ি ফেরা মানে কি নিজের কাছেই নিজে ফেরা নয়!