সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন ষষ্ঠদশ পর্ব
সূর্যোদয়ের সময় ঘুম ভেঙেছে। সকালটা স্নিগ্ধ। ভারী শীতের কাপড় জড়িয়ে জাহাজের ডেকে গিয়ে দাঁড়াই। আরও তিন-চারজন দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁরা বেশি পরিচিত নন, তাই ঠোঁটের কোণে একটু হাসি এনে তাঁদের দিকে তাকাই। তিনজন গাইড ওরনি হারবারের দিকে যাচ্ছেন। আজ আমাদের অপারেশন হাইকিং, যা এই পোতাশ্রয়ে হবে। তিনজন গাইড আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন হাইকিং করার জন্য জায়গাটা উপযুক্ত কি না। তারপর আমাদের ডেকে পাঠাবে।
হাইকিং আর কিছুই না, দীর্ঘ পথ জোরসে হাঁটা। এককালে মানুষ কেবল হেঁটেছে। গন্তব্যে গেছে হেঁটে, তীর্থে গেছে হেঁটে হেঁটে। আজকের এই আধুনিক যুগে আবার সেটা ফিরে এসেছে। আমরা তার নাম রেখেছি হাইকিং।
সকালের নাশতার প্লেটে অল্প খাবার নিয়েছি। সাঈদা বলল, ‘আরেকটু বেশি খাও মহুয়া, আজ কিন্তু বেশি খাটাখাটনি হবে।’
অপারেশনে যাওয়ার সময় খেয়াল করলাম জোডিয়াকে বেশ কিছু হাইকিং পোল (লাঠি) নিয়েছেন গাইড। সরঞ্জাম দেখেও মনে হলো আমাদের বেশ হাঁটতে হবে। একটা পাহাড়ের পাদদেশে আমাদের নামিয়ে দিলেন। এটিই ওরনি হারবার। পাহাড়সদৃশ পোতাশ্রয়টা বেলজীয়রা আবিষ্কার করেছে। তখন তিমি শিকারের জন্য পোতাশ্রয়ে আসত কত জাহাজ। এখন অদূরে আমাদেরটা ছাড়া আর কোনো জাহাজ নেই।
গাইডের হাতে মাঝারি সাইজের একটি প্ল্যাকার্ড। সেখানে ইংরেজিতে লেখা ‘সেভেনথ কন্টিনেন্ট’। গাইডের মুখ থমথমে মেঘের মতো। কারণ যে পাহাড়ে হাইকিং হবে সে পাহাড়ের বরফ পিচ্ছিল। পাহাড়ের বরফ যদি হয় ঝুরঝুরে তবে হাঁটার জন্য নিরাপদ, পিচ্ছিল হলে মুশকিল।
হাইকিং শুরু হওয়ার আগে হবে ফটোসেশন। পিচ্ছিল পাহাড়ের কথা ভুলে গেলাম। ছবি তুলতে আমার ক্লান্তি নেই। আমার দুটি ছবি তুলে দিলেন গাইড। তাতে কি আর আমার পোষায়! আমি মুখ গোমড়া করে বললাম, ‘দাও না আর দুখানা ছবি তুলে।’ গাইড আবার আমার ক্যামেরা হাতে নিলেন। এ দফায় তিনটা ছবি তুললেন। যেন তাঁর পয়সা খরচ হচ্ছে!
পাহাড়ে উঠতে সাহস হারাচ্ছি। পথ পিচ্ছিল। দুটি হাইকিং পোল নিয়েছি। শরীরের ভারসাম্য রাখার জন্য এটা চমৎকার। ধীরে হাঁটছি। সামনে-পেছনে আরও অভিযাত্রী। আমরা ওখানে পৌঁছানোর আগেই গাইডরা ছোট ছোট লাল পতাকা বরফে পুঁতে দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সীমানা ধরে হাঁটতে হবে। পাহাড় খুব বেশি উঁচু না। হাঁটা থামিয়ে পেছন ফিরে তাকাই। তাতে ক্লান্তি কমে। এখান থেকে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। অভাবনীয় সুন্দর। সমুদ্রে পাহাড় আর হিমশৈল ভাসছে। বাতাসে স্নো, মুখে তিরের মতো বিঁধছে। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার নেশায় সে হিম বাতাসকে তুচ্ছ জ্ঞান করি। পুরো পরিবেশ শুভ্রতায় আচ্ছন্ন।
আশপাশে সমুদ্র থেকে ভেসে ওঠা সব কটি পর্বতের মাথা দেখা যাচ্ছে। কোনো কোনো পর্বত থেকে বরফ খসে ভেতরের পাথুরে কৃষ্ণকায় শরীর উঁকি দিচ্ছে। এই যে বরফ গলে গেল, হাঁটতে অসুবিধা, এটা কিসের আলামত? জলবায়ু পরিবর্তন? যার ওপর দিয়ে হাঁটছি, এগুলো তো নিঃসন্দেহে বহু বছর টিকে থাকা তুষার এবং বরফের আচ্ছাদন। এসব গলে যাওয়া তো উষ্ণায়নের ফল। নভেম্বর-ডিসেম্বর এলে বিশ্বনেতারা হইচই ফেলে দেন। কার্বন নিঃসরণ কমানোর জারিগান শুরু করেন। আসলে কাজের কাজ কিছু হয় না।
আমি থামছি না। আমার পা চলছে। আমার পায়ের গতি ধীর কিন্তু মনোবল শক্ত। এই হাইকিং খেলা আমার কাছে। ৯০ মিনিটের ফুটবলের মতো। রেফারির বাঁশি না বাজা পর্যন্ত থামছি না।
গাইড বললেন, পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে ওপারে আর একটি উপসাগর দেখা যাবে। কিন্তু আমাদের সেই উপসাগর আর দেখা হয়নি। বৈরী পরিবেশের কারণে গাইড ‘খেলা’ শেষ হওয়ার আগেই বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে দিলেন। তিন গাইড মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের আর ওপরে যাওয়া মঙ্গলজনক হবে না। আমরা জোডিয়াকে ফিরে এলাম।
আজ দুপুরের রেস্তোরাঁ কিছুটা ম্রিয়মাণ। উচ্ছ্বাসের খামতি দেখা গেল। সবে খেতে বসেছি। রাশিয়ার ওলগা আমায় পেছন থেকে অর্ধ আলিঙ্গন করলেন। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত। আমি যে দাঁড়াব, সেই উপায়ও নেই। ‘বেশ কয়েক দিন ধরেই তোমার সঙ্গে কথা বলছে চাইছি, সময় সুযোগ মিলছিল না।’ শুনে তো আমি হকচকিয়ে গেলাম। আমার প্রতি এই ব্যাকুলতার কারণ কী! ওলগা বললেন, ‘তোমার দেশে যাওয়ার একটা পরিকল্পনা আছে। শিগগিরই। রাশিয়ার যে প্রতিষ্ঠানটি তোমার দেশে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প পরিচালনা করছে, আমি সেই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।’
এবার আমার কাছে সব পরিষ্কার হলো। আমার দেশের সঙ্গে সম্বন্ধ শুধু আমারই একার না। এ পৃথিবীর শেষ প্রান্তে আরও একজনকে পেলাম, তারও আছে আমার দেশের সঙ্গে নানা দায়দায়িত্ব ও দেনা-পাওনা। বললাম, ‘আমার অতিথি হও। আমি থাকি ঢাকায়। ঢাকায় দেখা হোক আমাদের।’ পাবনার রূপপুর তো এখন এক টুকরো রাশিয়া। পাঁচ হাজার রুশ নাগরিক আছে ওখানে। সুউচ্চ অট্টালিকা তৈরি হয়েছে তাঁদের জন্য। আশপাশের দোকানে বাংলার পাশাপাশি রুশ চর্চা হচ্ছে। ওলগা শুনে বেশ খুশি হন। তিনি আমার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর নিয়ে বিদায় নেন।
দিনের পর দিন জাহাজের খাবারঘরে বাহারি খাবার দেখে আমাদের চার নারীর মনে প্রশ্ন জাগে, যদি একবার দৌড়ে ঢুকে যাওয়া যেত জাহাজের রান্নাঘরে! দেখতাম জাহাজের কোনো ঘরে রাখা আছে প্রতি বেলায় দুই শ মানুষের প্রায় দুই সপ্তাহের খাবার। চার বান্ধবী মিলে বুদ্ধি করছি, দেব নাকি এক দৌড়!
১. অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?
২. ৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা
৩. ‘তোমরা আমাকে যেকোনো সময় হাগ করতে পারো’
৪. আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি
৫. অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে খেতে দিল রুটি আর বেগুন ভাজি
৬. অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম সন্তান প্রসব করেছিলেন যে নারী
৭. সাগরের পানিকে কেন বলা হতো কালাপানি
৮. অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে জাহাজ থেকে অভিযাত্রীদের যেভাবে নামতে হয়
৯. অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছে অভিযাত্রীদের মধ্যে আমিই প্রথম জাহাজ থেকে নামলাম
১০. দ্বীপটিতে পেঙ্গুইন ছাড়া আর কিছু নেই
১১. তিনটি তিমি আমাদের ঘিরে ধরল
১২. অ্যান্টার্কটিকায় যেভাবে উদ্যাপিত হলো জন্মদিন
১৩. পৃথিবীর সবচেয়ে দূরের ডাকঘর থেকে দুই ছেলেকে চিঠি পাঠালাম
১৪. মাসে মাত্র ১০০ শব্দের বার্তা পাঠাতে পারতেন তাঁরা, এতেই হতো যোগাযোগ