এক সকালে ঘুম থেকে উঠে শাহ জালাল আলিফ আর আরিফা শবনম আবিষ্কার করলেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে গড়ে তোলা তাঁদের ফেসবুক গ্রুপটা নাই হয়ে গেছে। গ্রুপে ছিল পাঁচ লাখের বেশি সদস্য। কত রকম নাচ, গানের ভিডিও, ছবি। স্প্যামিংয়ের কবলে পড়ে সব হাওয়া!
গ্রুপের নাম কাস্টঅ্যাওয়ে অন দ্য মুন (সিওটিএম)। এই নামে যে একটা কোরিয়ান চলচ্চিত্র আছে, আলিফ আর শবনম নাকি জানতেনই না! তাঁরা শুধু ভেবেছিলেন, এমন একটা উন্মুক্ত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলবেন, যেখানে যে যাঁর ইচ্ছেমতো নিজের প্রতিভা তুলে ধরার সুযোগ পাবে। সময়টা ২০২০ সাল। করোনায় সবাই তখন ঘরবন্দী। হাতে অফুরন্ত অবসর ছিল বলেই হয়তো নেটিজেনরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিতে শুরু করে। কাস্টঅ্যাওয়ে অন দ্য মুন গ্রুপে জমা হতে থাকে একের পর এক সৃজনশীল কনটেন্ট।
কেউ হয়তো ঘরবন্দী থেকেই জানালার ফাঁক দিয়ে দারুণ কোনো ছবি তুলেছেন। ছাদে বসে, খালি গলায় কেউ গেয়েছেন গান। কেউবা বসার ঘরের সোফাটা ঠেলেঠুলে সরিয়ে একটু জায়গা করে নিয়ে তুলে ফেলেছেন চমৎকার একটা নাচ। গ্রুপের সুবাদে এসব ছবি-ভিডিও পৌঁছে যায় অনেকের কাছে। এরই মধ্যে কাস্টঅ্যাওয়ে অন দ্য মুনের লাইভ সেশনগুলোতে যোগ দিতে শুরু করেন জনপ্রিয় তারকা, ইনফ্লুয়েন্সাররা। কিন্তু সব উৎসাহ–উদ্দীপনায় ভাটা পড়ে এক ধাক্কায়। ২০২১ সালের জুলাই মাসে হারিয়ে যায় গ্রুপটা।
‘আমাদের খুব মন খারাপ হয়েছিল। ২০২১ সালের কোরবানির ঈদের দিন আমরা আবার নতুন করে গ্রুপ খুললাম। ভেবেছিলাম সবাই নিশ্চয়ই ঈদ নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের গ্রুপটা যে হারিয়ে গেছে বা আবার ফিরে এসেছে, কেউ হয়তো খেয়ালই করবে না। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে প্রথম দিনেই সদস্যসংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেল। তিন দিনেই আমরা এক লাখ সদস্য ফিরে পেলাম,’ বলছিলেন শবনম।
সিওটিএম গ্রুপের সদস্যসংখ্যা এখন প্রায় ৪ লাখ ৭২ হাজার। আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র শাহ জালাল আলিফ এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষের ছাত্রী আরিফা শবনমের হাত ধরে যে প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছিল, এখন সেটি মোটামুটি সাংগঠনিক রূপ পেয়েছে। সারা দেশের প্রায় ছয় হাজার স্বেচ্ছাসেবক সিওটিএমের সঙ্গে যুক্ত আছেন। এই স্বেচ্ছাসেবকদের ১০টি ‘চেম্বার’-এ ভাগ করা হয়েছে। একেক চেম্বারের সদস্যরা নিজেদের মতো করে বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগও নিচ্ছেন। ‘প্রায়োরিটিজ—আ প্রোজেক্ট বাই সিওটিএম’ নামে ফেসবুক পেজটিতে চোখে পড়বে তাঁদের নানা দাতব্য কর্মকাণ্ড। ঢাকার কোনো দল হয়তো পথশিশুদের মধ্যে খাবার বিতরণ করছে। আবার শ্রীমঙ্গলে আরেক দল নিচ্ছে গাছ লাগানোর উদ্যোগ।
অনলাইনে তো সরব আছেই, অফলাইনেও মিলনমেলার আয়োজন করেন সিওটিএমের সদস্যরা। আলিফ ও শবনম জানালেন, এখন পর্যন্ত দুটি ‘মেগা গেট টুগেদার’ করেছেন তাঁরা। ফেসবুকে যাঁর নাচ, গান কিংবা আঁকা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন, গেট টুগেদারে তাঁর সঙ্গেই দেখা হয়ে গেছে।
এত বড় একটা গ্রুপ পরিচালনা সহজ কাজ না। যে কথা বলছিলেন শবনম, ‘আমাদের দেশে মুক্ত মন নিয়ে সৃজনশীলতার চর্চা করা খুব কঠিন। ফেসবুকে চ্যালেঞ্জটা আরও বেশি। প্রচুর নেতিবাচক মন্তব্য আসে। তবু আমরা যতটা সম্ভব গ্রুপের দেখভাল করার চেষ্টা করি। দেখেশুনে একেকটা পোস্ট অ্যাপ্রুভ করি। গ্রুপে কেউ কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করলে কিংবা কাউকে আক্রমণ করলে তাকে ব্যান (নিষিদ্ধ) করে দেওয়া হয়। প্রতিদিন প্রচুর মানুষকে ব্যান করতে হচ্ছে। তবু আমরা সব সময় চেয়েছি আমাদের গ্রুপটা উন্মুক্ত থাকুক। ইতিবাচক আলোচনা হোক।’
শবনমদের চাওয়াটা যে পূরণ হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। গ্রুপে একজন আরেকজনে প্রশংসা করছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন, ভুল ধরিয়ে দিচ্ছেন। নবিশদের সঙ্গে পেশাদারদের আলোচনার একটা সুযোগ হচ্ছে। কেউ হয়তো ঘরের কোণে বসে একা একা কোনো সৃজনশীল চর্চা করতেন, গ্রুপের সদস্যদের ‘রিঅ্যাক্ট’, ‘কমেন্ট’ পেয়ে তিনি উৎসাহী হচ্ছেন আরও।
দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পেরোনো দেবজ্যোতি বর্মণ যেমন ছবি আঁকতে ভালোবাসেন, আঁকাআঁকিটা স্রেফ শখ ছিল। সিওটিএমে নিজের আঁকা ছবি আপলোড করার পর বেশ সাড়া পেয়েছেন। এখন নিজস্ব একটা ফেসবুক পেজ খুলেছেন তিনি। বিক্রি করছেন নিজের তৈরি টুকটাক পণ্যও। দেবজ্যোতি বলছিলেন, ‘গ্রুপে এত মানুষের প্রশংসা না পেলে হয়তো আমার শখটা শুধু শখই থেকে যেত।’
ছোট ছোট ভিডিও বানিয়ে সিওটিএমে পোস্ট করতেন রায়হান রণ। এখন সাদিহান’স গ্যালারি নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালু করে ফেলেছেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের এই ছাত্র। পেশাদার ভিডিও তৈরির কাজ করছেন তিনি। রায়হান বলেন, ‘গ্রুপে অনেক প্রতিভাবান মানুষ আছেন। আমার কাজটা কেমন হলো, সেটা যেমন অন্যদের কাছ থেকে জানতে পারি, তেমনি অন্যদের কাজ দেখেও শেখার সুযোগ হয়। শুধু নিজের প্রোফাইলে কনটেন্ট আপলোড করলে হয়তো এত সাড়া পেতাম না। সিওটিএমের মাধ্যমে একটা বড় অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি।’
যখন কোভিড চলছিল, কাস্টঅ্যাওয়ে অন দ্য মুনের সঙ্গে আমার পরিচয় তখন। দেখলাম বাচ্চা বাচ্চা কিছু ছেলেমেয়ে একটা কিছু করার চেষ্টা করছে। নানা সেবামূলক কাজও ওরা করে। অনলাইনে, অফলাইনে যখনই তারা কোনো ভালো উদ্যোগ নেয়, পাশে থাকার চেষ্টা করি। আমরা শুধু বলি, আগামী প্রজন্মের হাতে পৃথিবী, আগামী প্রজন্মই সব। কিন্তু এই নতুন প্রজন্মের সঙ্গে যদি দুই কদম না চলি, ওদের সঙ্গে যদি কথা না বলি, তাহলে ওদের মনমানসিকতা বুঝব কী করে? আমি আশা করব, এই ছেলেমেয়েরা যখন বড় পদে যাবে, তখনো দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করবে।রাহুল আনন্দ, ভোকাল, জলের গান
এখন পর্যন্ত সিওটিএমের লাইভ সেশনগুলোতে হাজির হয়েছেন পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অভিনেতা মোশাররফ করিম, জলের গান ব্যান্ডের ভোকাল রাহুল আনন্দ, নৃত্যশিল্পী হৃদি শেখসহ অনেকে। আলিফ বলেন, ‘পেশাদার গ্রাফিকস ডিজাইনার, ফটোগ্রাফার, কার্টুনিস্ট, সংগীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, চলচ্চিত্র পরিচালক, ইনফ্লুয়েন্সারসহ অনেকেই আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। উৎসাহ দিয়েছেন। আমাদের গ্রুপে জমা পড়া পোস্টগুলো যাচাই–বাছাই করার জন্যও একটা ক্রিয়েটিভ টিম কাজ করছে। যে যে বিষয়ে দক্ষ, সে সে বিষয়ের পোস্টগুলো দেখে।’
আলিফ জানান, অনলাইনের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি বড় প্রতিযোগিতার আয়োজনও করেছেন তাঁরা। দেশের তরুণেরা তো বটেই, ভিনদেশ থেকেও অংশ নিয়েছেন অনেকে। বিচারকদের মধ্যেও ছিলেন ভিনদেশি শিল্পী, অভিজ্ঞজনেরা। রবি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, অপো, কোক স্টুডিও, নগদ, বিকাশ, চরকির মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডিজিটাল ক্যাম্পেইন বা ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কাজ করেছে সিওটিএম। দিনে দিনে পরিসরটা আরও বড় হচ্ছে।
কত বড়? আরিফা শবনম একটা গল্প শোনালেন, ‘আমরা গ্রুপের পক্ষ থেকে বিভিন্ন তারকাদের সঙ্গে দেখা করতে যাই। একবার একজন পরিচালকের কাছে যাচ্ছিলাম। আমরা সাধারণত কেক আর কিছু উপহার নিয়ে যাই। কেকের ওপর লেখা থাকে “লাভ ফ্রম সিওটিএম”। তো একবার একটা কেকের দোকানে লেখাটা লিখিয়ে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ দোকানদার বললেন, “সিওটিএম? ফেসবুকের ওই গ্রুপটা না? আপনাদের গ্রুপ আমার খুব পছন্দ। আমিও তো কেকের ওপর বিভিন্ন ডিজাইন করে পোস্ট করি। আমার পোস্ট দেখলে একটু অ্যাপ্রুভ করে দিয়েন, প্লিজ!” তাঁর কথা শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম। অনেক মানুষের কাছ থেকেই তো সমর্থন পাই। কিন্তু এই লোকটার কথা আমি কখনো ভুলব না।’