বইমেলায় গিয়ে ছবি তোলা, সে কি সহজ কাজ!

বইমেলা মানেই ভালোমতো দেখেশুনে বই কেনার সুযোগ
ছবি: আশরাফুল আলম

‘ছবি তোলা এত কঠিন একটা কাজ, তা–ও মানুষ ছবি তোলে!’—কথাটা কানে এল হঠাৎ। বই দেখছিলাম এক স্টলে। দর্শনার্থীদের ছবি তোলার ‘যন্ত্রণায়’ অতিষ্ঠ এক বিক্রয়কর্মী বলছিলেন কথাটা। ভেবে দেখলাম, ভুল কিন্তু বলেননি! বইমেলায় গিয়ে ছবি তোলা আসলেই খুব কঠিন কাজ! কীভাবে বইটা ধরা হলে এবং কোন দিক থেকে ছবিটা তোলা হলে পাঠক হিসেবে নিজের বৈদগ্ধ্য প্রমাণ করা যাবে, সেই অঙ্ক মেলানো চাট্টিখানি কথা নয়।

আবার ছবি তো শুধু ক্যামেরায় তুললেই চলে না, ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামেও তুলতে হয়। ক্লিকের পর ক্লিক। এত এত ক্লিক থেকে ঠিক ছবিটা খুঁজে বের করতে হবে। আপলোড, মানে তুলতে হবে। এরপর দেখতে হবে সেই ছবিতে কয়টা ‘রিঅ্যাকশন’ পড়ল, কয়টা ‘কমেন্ট’ পড়ল। কে লাইক দিল, কে ‘লাভ রিঅ্যাকশন’ দিল...কে আবার কোনো রিঅ্যাকশনই দিল না, সেটা খেয়াল করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কার কমেন্টের কী উত্তর দেওয়া হবে, সেটা নিয়ে ভাবনা তো আছেই!

নাহ, বিক্রয়কর্মী ভাই ঠিকই বলেছেন। ছবি তোলা আসলেই কঠিন কাজ। আরও এক মজার অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নিলেন তিনি আমাদের সঙ্গে। অন্য এক স্টল থেকে বই কিনে তাঁর স্টলের সামনে এসেই নাকি ছবি তোলেন অনেকে। আর সেই ছবি দেখে অন্যরা এসে ঠিক ওই বইটাই খোঁজেন। কেনার জন্য নয়, ছবি তোলার জন্য! গত কয়েক দিনে নাকি এমন ঘটনা অনেকবার ঘটেছে।

ছবি নিয়ে এত কথা কেন? সেজেগুজে মেলায় গিয়ে কয়েকটা ছবি তোলা তো কোনো অন্যায় নয়। কিন্তু যাঁরা বই দেখতে চাচ্ছেন, অন্যের ‘ফটোসেশন’ তাঁদের বিরক্তির কারণ হচ্ছে কি?

সেদিন গ্রামের বাড়ির আদলে গড়া এক প্যাভিলিয়নে উঠতে গিয়ে দেখি ওঠানামার জন্য রাখা সিঁড়ি দুটিই আটকানো। না না, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে আটকে দেওয়া হয়নি। তাহলে ঘটনাটা কী? তেমন কিছু নয়। ওঠানামার পথ আগলে চলছে ফটোসেশন।

সিঁড়ি পেরিয়ে খানিক পরে উঠলাম তো বটে। ভেতরে খানিক ঘুরেফিরে প্যাভিলিয়ন থেকে নামার সময়ও দেখি, ‘অবরোধ’ চলছে।

শুনে বই কেনা

বই কেবল দেখে নয়, শুনেও তো কিনব। কী শুনব? প্রথমে বিক্রয়কর্মীর প্রশ্ন, ‘কী ধরনের বই চাচ্ছিলেন?’ নিঃসন্দেহে পাঠককে সহযোগিতা করার মানসেই এই জিজ্ঞাসা। তবে একই প্রশ্ন শুনতে শুনতে কিন্তু বিরক্তও হন কোনো কোনো পাঠক। বইয়ের গুণকীর্তনও করেন বিক্রয়কর্মীরা। বিক্রিবাট্টার জন্য সেটুকু তো করবেনই। আর কী শুনি মেলায়? ক্রেতা বাড়তি মূল্যছাড়ের কথা বলছেন। বাংলা একাডেমির কোনো কাল্পনিক কর্তাব্যক্তির আত্মীয়ের পরিচয়ে বাড়তি মূল্যছাড়ের জন্য দুষ্টুমিও করছেন কোনো কমবয়সী ক্রেতা। এ তো মেলায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা নিষ্পাপ হাসির উপকরণ। সবকিছু শুনতে শুনতেই নিজের বই বাছাইয়ের পালা।

দেখেশুনে পছন্দ হলে, বাজেট মিললে তবেই কেনা হবে বই

বই না কেনা

এক ছুটির দিনের বিকেলে কোনো এক প্রকাশনীতে জনপ্রিয় লেখকের উপস্থিতির কারণে ওই প্রকাশনীর কাছাকাছি বেশ কয়েকটা সারিতে হাঁটার জায়গাটুকুও না পাওয়াটা দুঃখের। তবে সে তো পাঠকের দুঃখ। এমন প্রকাশনীও কিন্তু আছে, অমন ভয়ংকর ভিড়ের একটা বিকেল কাটার পরেও যাদের এক কপি বইও বিক্রি হয়নি। ঘুরতে ঘুরতে তেমন এক স্টলের সামনে যাওয়ার পর বিক্রয়কর্মী এক অদ্ভুত আবদার করে বসলেন, ‘একটা বইও যদি না নেন, তাহলে একটা বই তুলে আমার মাথায় একটা বাড়ি দিয়ে যান।’ একদিকে ‘ভাইরাল’ লেখকের জন্য উপচে পড়া ভিড়, অন্যদিকে আরেক বইয়ের স্টলে এমন কান্নার সুর। মেলা বোধ হয় এভাবেও ধারণ করে সমাজের চিত্রটাকে।

কোনো কোনো দিন মেলায় ঢোকার সময় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, ‘ব্যাগে লাইটার নেই তো?’ আমার সঙ্গে না হয় নেই। কিন্তু যাঁর সঙ্গে আছে, তিনি কি স্বীকার করেন প্রবেশপথে দায়িত্বরত পুলিশের কাছে? বোধ হয় না। নিষেধ না মানার মধ্যে সম্ভবত একধরনের আনন্দ আছে। এই যেমন বইমেলায় ঘোরার সময় মাথায় পরে থাকা সাধের ফুলের ব্যান্ডটা মেট্রো স্টেশনে নেওয়া নিষেধ। প্রবেশপথেই আছে ফুল নিয়ে ওঠার নিষেধাজ্ঞা। তবু ফুল নিয়ে ঢুকে যাচ্ছেন অনেকে। আদৌ কি নিষেধাজ্ঞার বাণী পড়ে দেখছেন তাঁরা? জানা নেই। এমন অনেক জানা-অজানার মধ্যেই শেষ হতে যাচ্ছে বইমেলা। আগামী বছর যখন বইমেলা আসবে, তত দিনে আমাদের জীবনে আরও কী কী পরিবর্তন জায়গা করে নেবে, কে জানে!