একা নারীর বিদেশজীবন

বিয়ের পর কাজ বা পড়াশোনার জন্য একা নারী বিদেশে গেলেও নানা কথা শুনতে হয়, সেই অভিজ্ঞতা লিখেছেন নুসরাত
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আমি পোল্যান্ডে আসি। প্রবাসজীবন নিয়ে মুখরোচক অনেক গল্প শুনেছি। বিদেশে পড়তে আসা মানেই যেন জমকালো জীবন। হয়তো আসলেই তাই। কিন্তু অনেক মেয়ের কাছেই, তার মধ্যে আমিও আছি, বিদেশে পড়তে আসা, তা–ও বিয়ের পর, বিভীষিকার আরেক নাম। এই বিদেশে আসা নিয়ে যে ভোগান্তিটা আমি ভুগেছি এবং এখনো ভুগছি, ঠিক ততটাই ভুগেছে আমার পরিবার।

‘ভাবি কি আসবে আর, নাকি থেকে যাবে?’ আজ এক বছর পরও অনেকের এ প্রশ্নের উত্তর হিমেলকে (লেখকের স্বামী, মেহেদি হাসান) দিতে হয়। শুধু তা–ই না, আমরা যে এখনো একসঙ্গে আছি, আলাদা হয়ে যাইনি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো দেখানোর মতো করে তার প্রমাণ দিতে হয়। হ্যাঁ, প্রমাণ দেওয়া আসলেই জরুরি।

একই সঙ্গে বিবাহিত জীবন, প্রবাসে শিক্ষাজীবন, ব্যবসা—সব সামলানোর কী পরীক্ষা আমি দিয়েছি, সেটা শুধু আমিই জানি। হঠাৎ অফিসের প্রয়োজন, টিকিট করে চলে এসেছি দেশে। সবাই দেখে, চাইলেই দেশে যেতে পারি। কিন্তু প্রতি মাসে ১৩ ঘণ্টার এ যাতায়াতের সঙ্গে রাতভর ট্রানজিটে বিমানবন্দরে ঘুমানোর স্ট্রেস কেউ দেখে না।

১০ বছর পড়াশোনার বাইরে থাকা নুসরাত ব্যাচেলর পড়তে পোলান্ডে আছেন

অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনলাইন ক্লাস, পরীক্ষার চাপ কেউ দেখে না। দেশে ফেরার সময় ইমিগ্রেশন পার হয়ে বিমানবন্দরে বসে অনলাইন ক্লাস কেউ দেখে না।

সবাই ভাবে, বিদেশ মানেই পার্টি। অনেক চিল। প্রতিবার দেশে যাওয়ার আগে সব পরিষ্কার করে গোছগাছ করে রাখা, এখানে সব নিজেকেই করতে হয় একা। কেউ পাশে থাকে না। মাঝেমধ্যে হিমেলকে ফোন করে গলা ছেড়ে কান্নাকাটি করি। দিন শেষে সবাই রঙিন ছবি দেখতে চায়। আমরাও দেখানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এই যে শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রমাণ দিতে হয় ‘ভাবি ফিরে আসবে,’ এটা শুধু আমি মেয়ে বলেই, ছেলে হলে হয়তো এ পরিস্থিতি কিছুটা সহজ হতো।

বিদেশে এসে বুঝেছি কার্ডে টাকা থাকলেই সব কেনা যায় না। হাতের ব্যাগটা ভারি হয়ে যাবে কি না, সেটাও দেখতে হয়। এখানে ঘরের সামনে এসে উবার থামে না। নিজের বোঝা নিজের হাতে তুলে নিয়ে একলা চলতে হয়। ফ্রিজের তিন দিনের বাসি খাবারও তাই অনায়াসে খেয়ে নিই। বিদেশ জীবনটা আসলে বিলাসিতার নয়। অনেক কিছু দেশে করা যায় না বলেই দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমায় মানুষ। ঠিক যেমন ১০ বছর পড়াশোনার বাইরে থাকা আমি ব্যাচেলর করতে এসেছি। দিন শেষে যখন দেশে যাই, সবার আগে নিজের বিছানায় গিয়ে বসি। সেই রাতে ভালো ঘুম হয়। একা একটা রুমে স্বর্গেও বোধ হয় মানুষের ভালো লাগবে না। দীর্ঘ পথে কিছু মানুষ পাশে ছিল বলেই সাহস পেয়েছি, চলতে পেরেছি।