৫২ বছর পর বাবাকে খুঁজে পেলাম

সিলেটের মানুষ জায়গাটাকে এত দিন ‘সালুটিকর বধ্যভূমি ও গণকবর’ নামে চিনত। সেটাই এখন ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহীদস্মৃতি উদ্যান’। শহীদদের স্মরণে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। আছে ৬৬ জন শহীদের স্মৃতিফলক। ৪ মার্চ এই শহীদ পরিবারের অনেকেই প্রথমবারের মতো গিয়েছিলেন শহীদস্মৃতি উদ্যানে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শহীদ গোকুলানন্দ চক্রবর্তীর সন্তান রিনি চক্রবর্তী। তিনি শুনিয়েছেন তাঁর বাবাকে হারানোর কষ্টগাথা।

বাবার স্মৃতিফলকের সামনে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রিনি চক্রবর্তী (ডানে)
ছবি: আনিস মাহমুদ

গোকুলানন্দ চক্রবর্তী—ফলকে জ্বলজ্বল করছিল নামটা। তারই পাশে ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে আছি। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে ভীষণ কান্না পাচ্ছে। একপর্যায়ে বসে পড়তে হলো। কিছুতেই আর সেখান থেকে উঠতে পারছিলাম না। একটা মানুষ, যাকে আমি একটা সাদা–কালো ছবিতেই শুধু দেখেছি, যে মানুষটা আমার বাবা, তাঁরই কাছে আজ এসেছি। আমাকে কাঁদতে দেখে পরিবারের অন্যরা এগিয়ে আসেন। বোঝান। তাঁদের কথায় সান্ত্বনা খুঁজি, সত্যিই তো, মানুষটা তো এখানেই আছে। এত দিন পর তাঁর অবস্থানটা তো অন্তত জানা গেছে। এখন মাঝেমধ্যে এখানে আসা যাবে। তাঁর নামফলকটা দেখে কিছুক্ষণ অন্তত কাঁদতে তো পারব। এতগুলো বছর পর এটাই তো বড় সান্ত্বনা।

১২ মে ১৯৭১। আমি তখন মায়ের গর্ভে। তবে বড়দের মুখে শুনে শুনে সেদিনের বিকেলটা মনের আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পাই। আমাদের বিশ্বনাথ উপজেলার বাড়িতে স্থানীয় রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে আসে। কিছুদিন ধরেই ওরা বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট চালাচ্ছিল। আমাদের বাড়িতেও সে কারণেই এসেছিল। এসে প্রথমে আমার দাদুকে ধরে নিয়ে যায়। সেটা দেখে এগিয়ে যান আমার কাকা। কাকাকেও আটক করে। তখন ঘরেই ঘুমাচ্ছিলেন বাবা। মা তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে সব জানান। দাদু ও কাকাকে কেন ধরা হয়েছে, খোঁজ নিতে যান বাবা। তারপর তাঁকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। চোখের সামনে বাড়িটায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আমার মা, দুই কাকা বাড়ির পেছনে আশ্রয় নেন।

শহীদদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ

দাদু, বাবা আর কাকাকে পরে অনেক খোঁজা হয়েছে। যেখানেই মৃতদেহ দেখা গেছে, সেখানেই ছুটে গেছেন কাকারা। কিন্তু কোনো খোঁজে পাননি। অনেক পর জানা যায়, তাঁদের হত্যা করে সালুটিকর বধ্যভূমিতে গণকবর দেওয়া হয়েছিল।

বাবা ছিলেন ইউনাইটেড ব্যাংকের (পরে জনতা ব্যাংক) ক্যাশিয়ার। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে বাবা-মায়ের বিয়ে হয়েছিল। দুই বছর পর আমার বড় ভাই প্রভাত চক্রবর্তীর জন্ম। আর আমার জন্ম একাত্তরের ২৫ ডিসেম্বর। শৈশবে সেভাবে বাবার শূন্যতা বুঝতে পারিনি। তবে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার অভাব বুঝতে শুরু করলাম। স্কুলে সবার বাবা আসে, আমার আসে না। কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগত। তখনো আমাদের সবার বিশ্বাস ছিল, আমাদের মাঝে তিনি একদিন ফিরে আসবেন। দিন যত গেছে বা যত বড় হয়েছি, সেই বিশ্বাস ফিকে হয়ে এসেছে। বাবা নেই, এটা যে কত বড় সংগ্রাম, তা বলে বোঝানো যাবে না। জন্মেছি যেমন সংগ্রামের সময়ে, বেড়েও উঠেছি সেই সংগ্রামেই।

অনুলিখন: মোছাব্বের হোসেন