যাঁর হাতে মিরাজের হাতেখড়ি

এমন অনেক খুদে ক্রিকেটারের হাতেখড়ি আল মাহমুদের হাতে
 ছবি: সাদ্দাম হোসেন

মিরাজ—একটা নাম নয় শুধু। একটা জয়ের গল্প। একজন মহানায়কের চরিত্র। অন্তত গতকাল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে তিনি ব্যাট হাতে যা করে দেখালেন, তাতে মিরাজকে জয়ের মহানায়ক তো বটেই, আরও কিছু বললেও বেশি বলা হবে না। এই ক্রিকেটারের ‘মিরাজ’ হয়ে ওঠার শুরুটা যাঁর হাত ধরে তিনি মো. আল মাহমুদ। মেহেদী হাসান মিরাজের প্রথম কোচ। খুলনার খালিশপুর এলাকার কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমির ক্রীড়া সম্পাদক ও প্রশিক্ষক তিনি। আল মাহমুদের হাতেই আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেটের হাতেখড়ি মিরাজের।

পাঁচ ভাইবোনের সবার বড় আল মাহমুদ। দায়িত্বও বেশি। কিন্তু খেলা যাঁর স্বপ্ন, খেলা যাঁর ধ্যানজ্ঞান, তিনি কি আর ঘর-গেরস্থালির মধ্যে নিজেকে ধরে রাখেন! নিজে জীবনে ডাকাবুকো ক্রিকেটার হতে পারেননি। তাতেই বা কী? তাঁর ক্রিকেট শেখানোর একাডেমিতে আছে বয়সভিত্তিকসহ জাতীয় দলে খেলা ক্রিকেটারেরা। যাঁদের মধ্যে মেহেদী হাসান মিরাজের কথা তো শুরুতেই বলা হলো।

২০১৬ সালে অভিষেক টেস্ট ম্যাচে ঘূর্ণি জাদুতে নিজেকে চিনিয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। সিরিজ শেষে ছুটে গিয়েছিলেন বাড়িতে, দেখা করতে ভোলেননি গুরুর সঙ্গে

মো. আল মাহমুদের বাড়ি ঝালকাঠি সদর উপজেলার পরমহল গ্রামে। বাবা মো. সামছুল আলম মুক্তিযোদ্ধা। পেশায় ছিলেন মোংলা বন্দরের নিরাপত্তা হাবিলদার। এখন অবসরে আছেন। চাকরির জন্য তিনি চলে আসেন খুলনায়। খুলনাতেই জন্ম আল মাহমুদের। এখন থাকেন খালিশপুর উত্তর কাশিপুরের এক ভাড়াবাড়িতে পরিবারের সঙ্গে।
ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলার প্রতি আল মাহমুদের ছিল প্রবল আগ্রহ। এলাকাভিত্তিক খেলা দিয়ে শুরু। খুলনা ও ঢাকা সিনিয়র ডিভিশনে খেলা কাশিপুর এলাকার ক্রিকেটার মো. ডিউককে দেখে আল মাহমুদের খেলা শুরু। ডিউক তাঁকে হাতে ধরে খেলা শিখিয়েছেন। এরপর ১৯৯৮ সালের দিকে আল মাহমুদ যোগ দেন কাশিপুর লিভারপুল ক্লাবে। মূলত ছিলেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। খেলেছেন দ্বিতীয় বিভাগ পর্যন্ত। হাঁটুর ইনজুরির কারণে খেলাকে বিদায় জানান ২০০৩ সালে।
নিজের খেলার অধ্যায় শেষ হলেও ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি আল মাহমুদ। নিজ হাতে ক্রিকেটার তৈরির স্বপ্ন দেখেন। ২০০৪ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে এলাকার শেখ খালিদ আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমি।
একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর শুনেছেন নানাজনের কটুকথা। প্রশ্ন উঠেছে তাঁর ক্যারিয়ার নিয়েও। কিন্তু দমে যাননি তিনি। আল মাহমুদ বলেন, ‘একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর খুব বেশি সাড়া পাইনি। আড়ালে অনেকে টিপ্পনীও কাটত। কিন্তু তাতে দমে যাইনি। চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করেছি। এখন এই একাডেমি প্রিমিয়ার ডিভিশন পর্যন্ত খেলে। এখন প্রশিক্ষণার্থী আছে দুই শতাধিক।’

আল মাহমুদ ২০০২ সালে এসএসসি পাস করেছেন নয়াবাটি হাজী শরীয়ত উল্লাহ বিদ্যাপীঠ থেকে। আর ২০০৬ সালে এইচএসসি পাস করেছেন খালিশপুরের মহসিন কলেজ থেকে।

২০০৬ সালের দিকে কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমিতে মিরাজের সঙ্গে পরিচয় আল মাহমুদের। তিনি বলতে থাকেন, ‘মিরাজের বয়স তখন মাত্র আট বছর। ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ দেখে রাসেল নামের একাডেমির এক ছাত্র মিরাজকে আমার কাছে নিয়ে আসে। ওই দিনই মিরাজকে নামিয়ে দিই অনুশীলনে। লিকলিকে গড়নের ছেলেটি প্রথম দিনই ভিন্ন কিছু করে দেখায়। তার বোলিং, ফিল্ডিং অ্যাকশন ছিল সবার থেকে আলাদা। ওই বয়সেই “কাঠের” বল ধরার কৌশল দেখে মুগ্ধ হই আমি।’ আর্থিক সামর্থ্য না থাকার পরও মিরাজকে অনুশীলনের সুযোগ দিয়েছিলেন কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমির প্রশিক্ষক মো. আল মাহমুদ।
অভাবের সংসারে বাবার বাধার কারণে মিরাজের খেলা প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল। তাই মিরাজের বাবাকে খেলায় বাধা না দিতে নানাভাবে বোঝাতেন মো. আল মাহমুদ। অনেক ছেলেকেই এভাবে সুযোগ করে দিয়েছেন এই একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার। পাশাপাশি নানা রকম সহযোগিতায় করেন তাদের।

আল মাহমুদের কথা সব সময় মানেন মিরাজ। গতকাল ভারতের বিপক্ষে জয়ের পরও মুঠোফোনে মিরাজের সঙ্গে কথা হয়েছে। মেহেদী হাসান মিরাজ যেমন তাঁর প্রথম কোচের কথা মনে রাখেন সব সময়, তেমনি আল মাহমুদও তাঁর এই প্রতিভাবান ছাত্রকে নিয়ে গর্ব করেন।

*২০১৬ সালের ১২ নভেম্বর প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’ প্রকাশিত লেখাটি এখানে ঈষৎ পরিবর্তন করে প্রকাশ করা হয়েছে।