পাঠ্যক্রম আর পরীক্ষার বদল হয় কেন

জুয়েল পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। ছোট বোন মারিয়া তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। নতুন বই নিয়ে স্কুল থেকে বাড়ির পথ ধরেছে দুই ভাই–বোন। ১ জানয়ারি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলা থেকে ছবিটি তুলেছেন সাদ্দাম হোসেন
জুয়েল পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। ছোট বোন মারিয়া তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। নতুন বই নিয়ে স্কুল থেকে বাড়ির পথ ধরেছে দুই ভাই–বোন। ১ জানয়ারি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলা থেকে ছবিটি তুলেছেন সাদ্দাম হোসেন

একজন ছোট শিশু যখন স্কুলে ভর্তি হয়, তার কাছে লেখাপড়ার মানে থাকে স্কুলে যাওয়া। আবার ওই শিক্ষার্থী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তার কাছে লেখাপড়া মানে হয় চাকরি পাওয়া। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—শিক্ষাজীবনের সব ক্ষেত্রেই নম্বরটা গুরুত্বপূর্ণ থাকে। তাই পরীক্ষা ভালো দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টাও হয়। এমনকি ভালো নম্বর তোলার জন্য পরীক্ষায় নকল করতেও আপত্তি থাকে না অনেকের। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারও ঘটে ভালো নম্বর তোলার লক্ষ্য থেকে।

ফলাফলটাই যখন লক্ষ্য, তখন পড়াশোনার যাবতীয় আয়োজন চলে পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে। নম্বর তোলার জন্য পরীক্ষার সময়ে সব কাজ বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীরা শুধু পড়তে থাকে। তাই অভিভাবকদেরও মনে হয়, পরীক্ষা থাকলে বুঝি কিছু পড়াশোনা হয়। রেজাল্ট ভালো করার জন্য শিক্ষার্থীদের ভালো নোট ফটোকপি করে মুখস্থ করতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোচিং বা প্রাইভেটেরও দরকার হয়। কিন্তু এমনটি হওয়ার কথা ছিল না।

শ্রেণিকক্ষে পাঠদান আর পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক আছে সিলেবাস বা পাঠ্যক্রমের। একটি নির্দিষ্ট সিলেবাসের অধীনে শিক্ষককে পড়াতে হয়, প্রশ্ন করতে হয়। শিক্ষার্থীকেও সেটি অনুসরণ করতে হয়। তবে প্রায়ই সিলেবাস আর পরীক্ষা পদ্ধতির বদল ঘটতে দেখা যায়। তখন নানা মহল থেকে আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। একদল সরাসরি পুরোনোর পক্ষে অবস্থান নেয়, আরেক দল নতুনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে থাকে। শিক্ষাবিশেষজ্ঞরা যেমন এ নিয়ে কথা বলেন, তেমনি সাধারণ অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও এ নিয়ে মন্তব্য করতে থাকে।

আসলেই কি সিলেবাস, পরীক্ষা—এসবের পরিবর্তনের দরকার আছে? এর উত্তরে সবাই বলবেন, অবশ্যই আছে। কারণ, সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনও বদলে যায়। যেমন এখন ক্যালকুলেটর থাকার কারণে নামতা মুখস্থ করাতে হয় না। আবার সার্চ করে তথ্য খুঁজে বের করার সুযোগ থাকায় পাঠ্যবইয়ে বেশি বেশি তথ্য থাকার দরকার নেই। জ্ঞানের রাজ্যে আর কাজের ক্ষেত্রে আরও কত রকমের পরিবর্তন যে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে, তার ইয়ত্তা নেই। তাহলে সিলেবাস, পরীক্ষার পরিবর্তন কি ফি বছর করতে হবে? সেটারও দরকার হয় না। এর পরিবর্তন হতে পারে মোটামুটি ১০ বছর পরপর। প্রয়োজন মনে করলে এর আগে-পরেও হতে পারে।

যুগের কথা মাথায় রেখে শিক্ষাবিষয়ক যাবতীয় পরিকল্পনা করতে হয়। এই পরিকল্পনা করার সময়ে একই বিষয়ে অন্য প্রতিষ্ঠান বা অন্য দেশ কী করছে, তারও খোঁজখবর নিতে হয়। নতুন পরিকল্পনা বাস্তবে প্রয়োগ করার আগে দেখে নিতে হয়, সেটি কতটুকু যথাযথ হলো। সে জন্য ফিল্ড টেস্ট বা পরীক্ষণের দরকার হয়। পরীক্ষণ পর্যায়ে নতুন করে সংযোজন-বিয়োজনের, এমনকি নতুনভাবে চিন্তা করার সুযোগ থাকে।

সমস্যা হলো, এই পরিবর্তনের পেছনে কারণ থাকা সত্ত্বেও একে মেনে নেওয়া অনেক সময় অন্যদের জন্য কঠিন হয়। এর বড় কারণ, নতুন পরিবর্তন কতটুকু কাজের হবে, সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকে। অনেকে আবার মনে করেন, আগের পদ্ধতি হয়তো সফল হয়নি, তাই পরিবর্তন করা হচ্ছে। আর গতানুগতিক ধারায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ার কারণে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ‘শিক্ষা ব্যবসা’র সঙ্গে যুক্ত অনেকেই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।

সাধারণ মানুষের জানা থাকে না, সিলেবাস আর পরীক্ষার পেছনে থাকে কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম। সেই শিক্ষাক্রম আবার প্রণীত হয় শিক্ষানীতির দ্বারা। শিক্ষাক্রমে শিক্ষার স্তরভিত্তিক যোগ্যতা বা লক্ষ্য স্থির করা থাকে। যেমন প্রথম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে কতটুকু যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করবে, সেটি নির্ধারণ করা থাকে। সেই দক্ষতা সে কতটুকু অর্জন করল, সেটা পরীক্ষা নিয়ে যাচাই করা হয়। পরীক্ষার সঙ্গে তাই নম্বরের ব্যাপারটি একেবারেই গৌণ। পরীক্ষা নিয়ে যদি দেখা যায় দক্ষতার ঘাটতি আছে, তবে সেটি পূরণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। সেটি কেন হয় না, তা নিয়ে বরং প্রশ্ন তোলার দরকার ছিল।

আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বা চাকরির ক্ষেত্রে যে পরীক্ষা নেওয়া হয়, সেটির ধরন আলাদা। স্কুল-কলেজের পরীক্ষা মানে দক্ষতার অবস্থান যাচাই করা। যেমন সাইকেল চালাতে পারা কোনো শ্রেণির কোনো একটি বিষয়ের নির্ধারিত যোগ্যতা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ওই শ্রেণিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা নিয়ে দেখতে হবে, তাদের কে কে সাইকেল চালাতে পারছে। আর ভর্তি পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় শিক্ষার্থীকে সরাসরি সাইকেল রেসে নামতে হয়। মানে, তখন দেখতে হয় কার আগে কে পৌঁছাবে।

পরিবর্তনের সফলতা আবার নির্ভর করে নিজের প্রতিষ্ঠানের বা দেশের সক্ষমতার ওপর। তা ছাড়া সম্পূর্ণ নতুন কিছু করতে হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, পুস্তকপ্রণেতা ও কর্তাব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের দরকার হয়। তবে একটি জায়গায় এখনো বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পর সিলেবাস ঠিক করতে হয়। শিক্ষাক্রমে লক্ষ্য নির্ধারণ করার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় অন্যান্য কৌশলও ঠিক করতে হয়। এসব কৌশলের মধ্যে আছে শ্রেণিতে পাঠ্যবই তৈরি করা, পাঠদান প্রক্রিয়া ঠিক করা, পরীক্ষা পদ্ধতি নির্ধারণ করা ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ বিভাগে কোনো শিক্ষাক্রমই থাকে না। আর সিলেবাস প্রণয়নের পর তারা লক্ষ্য ঠিক করে। ফলে শিক্ষার্থীরা ‘উচ্চশিক্ষিত’ হয়ে বের হওয়ার পরও তাদের বিষয়গত দক্ষতায় ঘাটতি রয়ে যায়।