বছর চারেক আগের কথা। অধ্যাপক কবিরুল বাশার একদিন খেয়াল করলেন, এডিস মশা রাতেও কামড়াচ্ছে। ওই স্থানে বৈদ্যুতিক আলো বেশি থাকায় এমনটি হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করেন তিনি। তবে অনুমানের মধ্যে আটকে না থেকে একটি গবেষণার কথা ভাবেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এই অধ্যাপক।
মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ে দীর্ঘ ২৩ বছর গবেষণা করছেন কবিরুল বাশার। এই কীটতত্ত্ববিদের নেতৃত্বেই একটি গবেষণা দল দেশের পাঁচটি অঞ্চলে তিন বছর ধরে মশার বংশবিস্তার নিয়ে গবেষণা করেন। এই গবেষণাতেই জানা গেছে, এডিস মশার আচরণে পরিবর্তন এসেছে। ডেঙ্গুবাহক এডিস শুধু দিনে নয়, রাতেও কামড়ায়।
কবিরুল বাশার বলেন, ‘এডিস মশা শুধু দিনে কামড়ায় বলে আমরা জানতাম। আমি নিজেও সেটি বলে এসেছি বহুদিন। এই মশা সাধারণত সূর্যোদয়ের পর এবং সূর্যাস্ত যাওয়ার আগে বেশি কামড়ায়। তবে রাতেও এই মশা মানুষকে কামড়ায় কিন্তু সেটার হার তুলনামূলক কম।’
গবেষণাটি কীভাবে করা হয়েছে জানতে চাইলে কবিরুল বাশার বলেন, ‘এডিস মশা রাতে কামড়ায় কি না, এটি পরীক্ষার জন্য আমি একজন মানুষকে মশারির ভেতরে রাখি। তখন তাকে কামড়াতে আসা মশাগুলোকে জীবিত ধরে ধরে একটি কাপে সংগ্রহ করি। তারপর সেই মশাগুলোকে পরীক্ষাগারে এনে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে মাইক্রোস্কোপের নিচে এনে দেখি এগুলো কোন প্রজাতির মশা। পরীক্ষায় এসব মশার কামড়ানোর ধরন, কামড়ানোর সময় বা কর্মকাণ্ডের ধরন একেক রকম দেখতে পাই। পরে দেখা যায়, রাতের বেলা কামড়ানো মশাগুলোর মধ্যে এডিস মশাও আছে। তবে রাতের বেলায় এই মশার কামড়ানোর হার কিছুটা কম থাকে।’
রাতেও এডিস মশা কামড়ানোর কারণ জানতে চাইলে অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘মশা যেকোনো পরিবর্তিত ও প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। আর যদি সেটি ডেঙ্গুর প্রধান বাহক এডিস ইজিপ্টি হয়, তাহলে তো কথাই নেই। জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্যের কারণে এই মশা অত্যন্ত সুচতুরভাবে নিজেকে পরিবর্তিত করে নিয়েছে। অথবা এটাও হতে পারে আমরা আগে ভুল জানতাম যে এডিস মশা রাতে কামড়ায় না।’
২০২২ সালে আরেকটি গবেষণায় কবিরুল বাশার দেখেন, সব ধরনের পানিতেই বংশবিস্তার করতে পারে এডিস মশা। এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে, এটাই এত দিন জানা ছিল। তাঁরা গবেষণায় পেয়েছেন সুয়ারেজ, ড্রেন এমনকি সমুদ্রের নোনা পানিতেও ডিম পাড়তে এবং জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে এডিস মশা। জমে থাকা এক সেন্টিমিটার পানিতেও এডিস মশার বংশবৃদ্ধির প্রমাণ মিলেছে। শুষ্ক অবস্থায় এডিস মশার ডিম ৬-৯ মাস পর্যন্ত জীবিত থাকে এবং সামান্য পানির সংস্পর্শে এলেই সেটি ফুটে তৈরি হয় লার্ভা।
মশা গবেষক কবিরুল বাশার বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গবেষণায় এখন পর্যন্ত ১২৬ প্রজাতির মশার কথা জানা গেলেও বর্তমানে দেশে প্রায় ১০০ প্রজাতির মশা রয়েছে। এসব মশার মধ্যে ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়াসহ বিভিন্ন রোগ ছড়ায় মাত্র ২২ প্রজাতির মশা। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা মাত্র ২ শতাংশের কম। এডিস মশার দুই প্রজাতির মধ্যে এডিস ইজিপ্টিই প্রধান ডেঙ্গু বাহক। এই মশা আবার বসতবাড়িতে থাকতে পছন্দ করে। তাই একে গৃহপালিত মশাও বলা যায়।
ডেঙ্গু রোগ থেকে বাঁচার উপায় কী জানতে চাইলে কবিরুল বাশার বলেন, আচরণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে মশা সুপার পতঙ্গে পরিণত হচ্ছে। তাই মশার আচরণ এবং মশা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। মশার পরিবর্তিত আচরণ জেনে আমরা যদি সঠিক নিয়ন্ত্রণপদ্ধতি উদ্ভাবন ও তার প্রয়োগ করতে পারি, তখনই একে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে। আর এই মশাকে শাসনে এনে রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে।