বাণিজ্যিক ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং অন্যান্য জনসমাগমস্থলে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে অধিকসংখ্যক প্রাণহানির ঝুঁকি থাকে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্নটা যখন জীবনের, তখন হেলাফেলার সুযোগ নেই, নেই নিয়মকানুন শিথিল করার অবকাশও। অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে আগুন বা ধোঁয়া শনাক্তকরণ, অগ্নিনির্বাপণ এবং আগুন লাগলে নিরাপদে বহির্গমনের ব্যবস্থা থাকতে হবে সব ধরনের ভবনেই। আগুন লেগে গেলে কী করতে হবে, সেটিও জানা থাকতে হবে ছোট-বড় সবারই।
অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩ অনুসারে, ছয়তলার চেয়ে বেশি উচ্চতার আবাসিক ভবন এবং যেকোনো উচ্চতার অনাবাসিক ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদনের জন্য এবং অনুমোদিত নকশার সংশোধনের জন্য ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালকের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। শুধু তা-ই নয়, জাতীয় ভবন নির্মাণ বিধিমালা, ২০২০ অনুসারে, এসব ভবন বা স্থাপনা ব্যবহার শুরু করার আগেই ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ের অনুমোদন নিতে হবে।
অগ্নিদুর্ঘটনায় সচেতন থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের তালিকাভুক্ত অগ্নিনিরাপত্তা পরামর্শক এবং অ্যাশরে বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতি প্রকৌশলী মো. হাসমতুজ্জামান—
জ্বালানিসংক্রান্ত দুর্ঘটনা
আবাসিক ভবনে যেমন চুলা জ্বালানো হয়, তেমনি হোটেল-রেস্তোরাঁ, অফিস কিংবা অন্যান্য বাণিজ্যিক ভবনেও চুলা জ্বালানোর প্রয়োজন হয়ে থাকে। শহুরে জীবনধারায় অভ্যস্ত ব্যক্তি হঠাৎ গ্রামে গেলে কিংবা গ্রামীণ জীবনে অভ্যস্ত ব্যক্তি হঠাৎ শহরে এলে জ্বালানিসংক্রান্ত সমস্যায় পড়তে পারেন। আবার চিরকালের অভ্যস্ত ব্যক্তিও ক্ষণিকের ভুলে বিপদগ্রস্ত হতে পারেন। তাই কিছু বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখুন সব সময়—
যেকোনো স্থানে গ্যাসের চুলা, এমনকি ম্যাচের কাঠি বা লাইটার জ্বালানোর আগে সেই স্থানে বাতাস চলাচল নিশ্চিত করুন। বদ্ধ রান্নাঘরে আগুন তো জ্বালানো যাবেই না, বরং যেকোনো বদ্ধ ঘরে ঢুকলে আপনার প্রথম কাজই হবে সব দরজা-জানালা আগে খুলে দেওয়া। সম্ভব হলে দরজা-জানালা বেশ কয়েকবার এপাশ-ওপাশ করার মাধ্যমে জমে থাকা বাতাস সরিয়ে দিন। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী ঘরের বৈদ্যুতিক সুইচ অন করুন কিংবা আগুন জ্বালান। মনে রাখবেন, বদ্ধ রান্নাঘরে কেবল বৈদ্যুতিক স্পার্ক থেকেই আগুন ধরে যেতে পারে জমে থাকা গ্যাসের কারণে।
গ্যাসের চুলার রক্ষণাবেক্ষণে সতর্ক থাকুন। চুলার যন্ত্রাংশ পানিতে ধোবেন না। রোজ শুকনা কাপড় দিয়ে মুছে নিন। কাপড়টি (পানি নয়) প্রয়োজনে ভিনেগার দিয়ে ভিজিয়ে নিন।
চুলায় রান্না বসিয়ে লম্বা সময়ের জন্য অন্য কোনো ঘরে চলে যাওয়া উচিত নয়।
রান্নার সময় ছাড়া চুলা জ্বালিয়ে রাখবেন না। চুলার ওপর কাপড় শুকাতে দেবেন না।
অত্যধিক ক্লান্তি নিয়ে রান্নাঘরে কাজ করবেন না। কারও কারও ঘুমের সময় শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যাঘাত ঘটে, যা একটি রোগ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া। রোগটি জটিলতর রূপ ধারণ করলে রোগী দিনের বেলা নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। এমন রোগীর রান্নাঘরে কাজ না করাই নিরাপদ। কারণ, রোগীর ঘুমের ভাব চলে এলে যেকোনো মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
শিশু ও পোষা প্রাণীদের চুলা, জ্বালানি এবং দাহ্য বস্তু থেকে দূরে রাখুন।
গ্যাস সিলিন্ডার পরিবহনে সতর্কতা অবলম্বন করুন।
মাটির চুলা ব্যবহার শেষে ভালোভাবে নিভিয়ে ফেলুন। চুলার ওপর লাকড়ি বা কাঠ চাপা দিতে হলে চুলা সম্পূর্ণ নিভে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
কেরোসিন রাখতে হলে ভালোভাবে মুখ আটকে রাখুন।
আবাসিক ভবনের জন্য আরও যা প্রয়োজন
দিন দিন বাড়ছে বহুতল ভবনের সংখ্যা। যেখানে কেবল অ্যাপার্টমেন্টের মালিকানা হয়তো আপনার, পুরো ভবনটা কারও একার নয়। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগী হতে পারেন যে কেউ। তাই বিধিমালা অনুসারে অগ্নিনির্বাপণ ও জরুরি বহির্গমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখুন। একটি পরিবারের একটি বাড়ি হলে সেখানে ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশারের সিলিন্ডার থাকাই যথেষ্ট। মেয়াদ পেরিয়ে গেলে নতুন ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশারের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে রাখতে হবে সতর্কতামূলক আরও ব্যবস্থা। যেকোনো ভবনের ক্ষেত্রেই কার্পেটজাতীয় দাহ্যসামগ্রী এড়িয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এগুলোতে সহজে আগুন ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে।
তা ছাড়া অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে আরও যা চাই—
১০ তলার বেশি উচ্চতার ভবনের জন্য স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা, যা আগুন এবং ধোঁয়া শনাক্ত করে অ্যালার্ম সক্রিয় করে দেবে। আরও চাই ওয়াটার হাইড্র্যান্ট সিস্টেম, যাতে পাম্প এবং হোসপাইপের সাহায্যে পানির ব্যবস্থা করা যাবে। এই সিস্টেম কার্যকর করতে জলাধারও আবশ্যক।
১০ তলার বেশি উচ্চতার ভবনে সাধারণ সিঁড়ি ছাড়াও চাই ফায়ার স্টেয়ার (জরুরি বহির্গমন পথ)। ফায়ার ডোর এবং ফায়ার লিফটও থাকা উচিত। ফায়ার ডোর সব সময় বন্ধ রাখতে হবে, যাতে আগুন লেগে গেলে আগুন ও ধোঁয়া একাধিক তলায় ছড়িয়ে না পড়তে পারে। এর কম উচ্চতার ভবনেও যদি প্রতি তলায় চারটির বেশি ইউনিট থাকে কিংবা প্রতি তলায় ৫০ জনের বেশি মানুষ থাকে, তাহলেও এসব ব্যবস্থা থাকতে হবে।
আন্তর্জাতিক ভবন নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে, ৫৫ ফুটের বেশি উচ্চতার আবাসিক ভবন হলেই তাতে অটোমেটিক স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম রাখতে হবে। অর্থাৎ, আগুন লেগে গেলে বা তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছড়ানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। যেটা রাখা হলে ওই মুহূর্তে আগুন নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনো ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত না থাকলেও আগুনে ক্ষতি কম হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক আরও বিষয়
আবাসিক ভবনের জন্য যতগুলো ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা হলো, অফিসের উচ্চতা ৬৭ ফুটের বেশি হলেই সেখানে এসব ব্যবস্থা রাখতে হবে (আন্তর্জাতিক ভবন নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে)। ফায়ার ব্রিগেড কানেকশনসহ ফায়ার হাইড্র্যান্ট ও স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম থাকলে ফায়ার ব্রিগেড আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারে। শপিং কমপ্লেক্স, হোটেল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মতো সব প্রতিষ্ঠানেই এই কার্যকরী ব্যবস্থা মেনে চলা উচিত। তবে কোনো হোটেল তিনতলা হলে কিংবা যেকোনো উচ্চতার হোটেলে ২০ জনের বেশি মানুষ থাকার ব্যবস্থা থাকলে আন্তর্জাতিক ফায়ার কোড অনুসারে সেখানে অটোমেটিক স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম থাকতে হবে।
কলকারখানা ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা
৭৫০ বর্গমিটারের চেয়ে ছোট কারখানায় কেবল ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার থাকলেই চলবে। তবে এর চেয়ে বড় কারখানার জন্য অবশ্যই ওয়াটার হাইড্র্যান্ট সিস্টেম ও জলাধার রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক বিধিমালা অনুসরণ করলে এসব কারখানাতেও অটোমেটিক স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম রাখতে হবে। ফায়ার ব্রিগেড কানেকশন থাকাও খুব প্রয়োজন। আমাদের দেশে উচ্চ ঝুঁকির অনেক ছোটখাটো কারখানা ও গুদামঘর রয়েছে; পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার, নিউ সুপারমার্কেটের মতো অনেক ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট রয়েছে। এসব স্থানে এ ধরনের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা করা হলে দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
আগুন লেগে গেলে
আগুন লেগে গেলে একটি ভবন থেকে কীভাবে কোন পথে নিরাপদে বেরোনো যাবে, তা জানা থাকতে হবে সবারই। আগুন লাগলে মাথা ঠান্ডা রেখে শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি এবং পোষা প্রাণীদের সঙ্গে নিয়ে নিরাপদে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। বের হওয়ার স্থানে হুড়োহুড়ি, ধাক্কাধাক্কি করা যাবে না। ধোঁয়ার সংস্পর্শে এলে ভেজা তোয়ালে বা ভেজা কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে ফেলতে চেষ্টা করুন। অন্যদেরও এ ব্যাপারে সহযোগিতা করুন।
আগুনের বিস্তৃতি খুব বেশি না হলে বের হওয়ার চেষ্টা করার আগে ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার ব্যবহার করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করুন। এর ব্যবহার খুবই সহজ। সবারই জানা থাকা প্রয়োজন।
বিস্তৃত আগুনের জন্য ওয়াটার হাইড্র্যান্ট সিস্টেম চালু করতে পারলে ভালো। এটা চালানো জটিল কিছু নয়। এর ব্যবহার সবারই জানা উচিত।
সতর্ক থাকুন
জ্বলন্ত সিগারেট যেখানে–সেখানে ফেলবেন না। আপনি হয়তো কোথাও সিগারেট ফেলেই প্রবল গতির বাহনে চলে গেলেন বহুদূর, কিন্তু আপনার ফেলে দেওয়া সিগারেটের টুকরা থেকেই ওই স্থানে হতে পারে অগ্নিদুর্ঘটনার সূত্রপাত। আনন্দ-উৎসবে পটকাবাজির চল নতুন নয়। হালে এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফানুস। নববর্ষ, সাকরাইন, এমনকি পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক উৎসব উদ্যাপনেও পটকাবাজি আর ফানুসের ব্যবহার দেখা যায়। অথচ এই আনন্দই কখনো কখনো রূপ নেয় বিষাদে। পটকাবাজি আর ফানুস থেকে সৃষ্ট আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন উদ্যাপনকারী ব্যক্তি নিজে, উৎসবস্থল থেকে বেশ দূরে থাকা কোনো ব্যক্তি বা ভবনেও আগুনের সূত্রপাত হতে দেখা যায়। অথচ যেকোনো উৎসবের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে কল্যাণভাবনা। সেই ভাবনার ফাঁক গলে ঘটে যাবে দুর্ঘটনা? কেবল আইনপ্রণয়নকারী সংস্থার কড়াকড়ি নিয়মের মাধ্যমেই নয়, বরং বিবেকের জাগরণেই দূর হোক অকল্যাণ। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পটকাবাজি আর ফানুস দিয়ে উৎসব উদ্যাপন কখনোই সুস্থ বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। আগামী দিনগুলোয় যেন কখনোই এগুলো থেকে সৃষ্ট আগুন কোনো ব্যক্তির জানমালের ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, এমনকি একটি পাখির ছোট্ট নীড়ও যেন পুড়ে না যায় এভাবে।