সে আমাকে বোনের চোখেই দেখে

আমাদের আহ্বানে ভালোবাসার টক–ঝাল–মিষ্টি গল্প লিখে পাঠিয়েছেন পাঠক। গত সংখ্যার পর বাছাই আরও একটি লেখা ছাপা হলো ‘ছুটির দিনে’র এ সংখ্যায়

তার সঙ্গে বয়সের তফাত প্রায় ১১ বছর। সে লম্বামতো একজন মানুষ, আর আমি ছোটখাটো বামনের মতো। কলেজে যখন উঠলাম, তখন তার চশমার ফাঁকে লাজুক চোখজোড়া, টোলপড়া মাপা হাসি আর ইতস্তত স্বভাবটার প্রেমে পড়া। ২০২১ সালের রোজার ঈদে প্রথম তার একদম পাশ ঘেঁষে কথা বলা। এত লজ্জা লাগছিল! আর ভয়ও।

সম্পর্কে যদিও সে ছিল খালাতো ভাই, কিন্তু সামান্য কুশল বিনিময় ছাড়া এর আগে কখনোই তেমন আলাপ হতো না। আজও মনে পড়ে, এত কাছ থেকে তাকে দেখে খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম। লজ্জায় মনে হচ্ছিল, না, এর সঙ্গে প্রেম করার দরকার নেই। তবু বেড়ে গেল তাদের বাড়িতে যাওয়া। লাভ হতো না, সে বাড়িই থাকত না। সারা দিন অফিস শেষে আবার বন্ধুদের সঙ্গে নাকি আড্ডা দিত। নানা পাগলামোর পর বুঝলাম, সে বোনের চোখেই দেখে, তাই গুটিয়ে এলাম।

সময়টা তখন খারাপ যাচ্ছিল। এইচএসসি পরীক্ষার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায়ও খারাপ রেজাল্ট হলো। সবার থেকে আলাদা হয়ে একটা লম্বা ডিপ্রেশনের পর প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি হলাম। আস্তে আস্তে সব ঠিক হতে লাগল। একসময় আমিও অন্য মানুষ হয়ে উঠলাম, যাকে বলে একদম গুরুগম্ভীর, শান্তশিষ্ট।

বহুদিন পর আবার সবার সঙ্গে দেখা শুরু হলো। খালার বাসায় কিংবা বিভিন্ন ফ্যামিলি গেদারিংয়ে তার সঙ্গেও দেখা হতে লাগল। সে বোধ হয় লক্ষ করল আমার বদলটা—গায়ে পড়ে কথা নেই, নেই কথা বলায় হড়বড়ামি, নেই ‘হাই’, ‘হ্যালো’। তবে বদল দেখতে পেলাম আমিও, তার মধ্যে। আমার দিকে আকুল হয়ে তাকিয়ে থাকা।

এভাবে চলতে লাগল। পাত্তা দিতাম না। তত দিনে বেশ বাস্তববাদী হয়ে গেছি। বলতে পারব না, মধ্যে কীভাবে কী হলো, মনে পড়ে শরতের সকালে ছাদের দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দুজন দুজনের দিকে বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকা। তারপর এক শীতের সন্ধ্যায় সেই চৌকাঠে প্রথম হাত ধরা। আমি প্রেমপত্র জিনিসটা খুব পছন্দ করতাম। একটু ওল্ড-ফ্যাশনড ছিলাম। গত বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি ক্লাস শেষে বেরিয়ে দেখি, ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে সে, হাতে গিফট ব্যাগ। হন্তদন্ত হয়ে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়েই একরকম পালিয়ে গেল।

বাসায় এসে দরজা আটকে দুরুদুরু বুকে ব্যাগ খুলে পেলাম জীবনের প্রথম প্রেমপত্র এবং একটা মিশকালো আর গাঢ় কমলা বাটিকের সুতির শাড়ি। একবার তাকে শুনিয়ে জোরে জোরে বলেছিলাম, ‘বাটিকের সুতি শাড়ি আমার ফেবারিট।’ এত কিছু মনে রেখেছে! রাতে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে দুজনের ফোনে কথা বলা।

আসলে ও ছিল বড় লাজুক। আমার ফ্যামিলি খুব কড়া ছিল, একা বের হতে দিত না। রাত জেগে কথা বলারও সুযোগ ছিল না। ও থাকত ওর চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, আর আমি আমার ক্লাসে। তবুও চলত আমাদের লুকোচুরি প্রেম। একটা সময় বাসা থেকে বিয়ের চাপ শুরু হলো, ওর বয়সও তত দিনে তিরিশের কোটায়। দুজনে ভাবছিলাম, কীভাবে পরিবারকে জানাব। বিয়ের প্রস্তাব আসছে শুনে ও অস্থির হয়ে উঠল। অবশেষে দুজনের পরিবারকে জানানো হলো। প্রচুর ঝড়ঝাপটা সামাল দিতে হলো। সব ঝামেলার পর ১৭ জানুয়ারি আমাদের বিয়ে হয়েছে।

পারিবারিক কিছু সমস্যা এখনো আছে, তারপরও আমরা দুজনই দুজনকে পেয়ে মহাখুশি। আজও আমার লম্বা চুল থেকে ও নাকি মোহ কাটাতে পারেনি। হিল পরার অভ্যাস আমার কখনোই ছিল না। এখনো পরতে পারি না। তাই ওর পাশে দাঁড়ালে নিজেকে মনে হয় আরও খাটো। কিন্তু ওর নাকি এটাই ভালো লাগে। যখন-তখন কোলে তুলে নেয়। ওর অগোছালো স্বভাব আর বোকা হাসি আমারও ভালো লাগে। দুজনে এভাবেই চিরতরে হারিয়ে যেতে চাই দুজনের মধ্যে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, মালিবাগ, ঢাকা