‘জাপানিজ স্টাডিজ’ বিভাগে কী পড়ানো হয়, কী কী সুযোগ

জাপানিজ স্টাডিজে স্নাতক করলে পাঠ্যক্রম অনুযায়ীই শিক্ষার্থীর তৃতীয় পর্যায় পর্যন্ত জাপানি ভাষা শিক্ষা হয়ে যায়
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানিজ স্টাডিজ বিষয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি চালু হয় ২০১৭ সালে। একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি পেশাদার কোর্সও করার সুযোগ আছে। চার বছরের স্নাতক কোর্সে আদতে কী পড়ানো হয়? এই বিভাগে পড়লেই কি উচ্চশিক্ষা বা চাকরির জন্য জাপানে যাওয়া যায়? এমন নানা বিষয়ে খোঁজ নিয়েছিলাম আমরা।

যা পড়ানো হয়

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা, আইন ও সামাজিক ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে জাপানিজ স্টাডিজে ভর্তি হওয়া যায়। আগে এটি ‘ঘ’ ইউনিটের অধীনে ছিল। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীন এই বিষয়ে স্নাতকোত্তরের জন্য ৩২টি কোর্সে শিক্ষার্থীদের অর্জন করতে হয় ১২৮ ক্রেডিট। বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইফুল্লাহ আকন জানান, প্রথম বর্ষে অর্থনীতি, সোশিওলজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতির সাধারণ বিষয়, বাংলাদেশ স্টাডিজ, জাপানের আর্থিক উন্নয়নসংক্রান্ত কোর্স পড়ানো হয়। দ্বিতীয় বর্ষে জাপানের ব্যবসা ও যোগাযোগ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত বিষয় সম্পর্কে পড়েন শিক্ষার্থীরা।

তৃতীয় বর্ষে জাপানের রাজনীতি, অর্থনীতি, জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কের নানা বিষয়সহ মৌলিক গবেষণার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়ালেখার সুযোগ থাকে। চতুর্থ বর্ষে গবেষণার পাশাপাশি ইন্টার্নশিপ করতে পারেন শিক্ষার্থীরা। জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের স্নাতক সরাসরি মাস্টার্সের জন্য ভর্তি হয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে স্নাতক করেও ‘মাস্টার্স ইন জাপানিজ স্টাডিজ’ (এমজেএস) ডিগ্রির জন্য আবেদন করতে পারেন। এ বিভাগে জাপানিজ স্টাডিজসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামেও ভর্তির সুযোগ আছে।

ভর্তির বিস্তারিত জানা যাবে এই লিংকে

জাপানিজ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ভাষা শেখা ও চর্চার সুযোগ পাচ্ছেন

জাপানি ভাষার ল্যাব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজুকো ভূঁইয়া ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সহায়তায় বিশেষায়িত ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইফুল্লাহ আকন জানান, শিক্ষার্থীদের ভাষা দক্ষতা ও জাপানি সংস্কৃতি সম্পর্কে জানাতে জাপানি শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা প্রশিক্ষণ দেন। প্রতিটি সেমিস্টারে শিক্ষার্থীরা একটু একটু করে জাপানি ভাষা শেখার সুযোগ পান। আইইএলটিএস-টোয়েফলের মতো জাপানিজ ল্যাঙ্গুয়েজ প্রফিসিয়েন্সি টেস্টটি জেএলপিটি নামে পরিচিত। এই পরীক্ষায় পাঁচটি পর্যায়ে (লেভেল) শিক্ষার্থীরা জাপানি ভাষা দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ পান। জাপানিজ স্টাডিজে স্নাতক করলে পাঠ্যক্রম অনুযায়ীই শিক্ষার্থীর তৃতীয় পর্যায় পর্যন্ত জাপানি ভাষা শিক্ষা হয়ে যায়।

সাংস্কৃতিক সংযোগ

জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন রাবেয়া আক্তার। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে নিয়মিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্যারিয়ার মেলা, চলচ্চিত্র উৎসবের মতো আয়োজনকে তাঁদের বিভাগে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জাপানিজ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ভাষা শেখা ও চর্চার সুযোগ পাচ্ছেন। এ ছাড়া ইংলিশ ক্লাব, বিতর্ক ক্লাব, বুক ক্লাবের মতো সংগঠনে শিক্ষার্থীরা যুক্ত হতে পারেন। বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও বিতর্ক ক্লাবের সদস্য মাহবুবুল নেওয়াজ বলেন, ‘আমরা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অন্য সব বিষয়ের মতোই নানা ধরনের কোর্স করার সুযোগ পাই। এ ছাড়া জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনে আমাদের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ থাকে। জাপানি চলচ্চিত্র দেখা থেকে শুরু করে জাপানি সাংস্কৃতিক সপ্তাহের মতো বিষয় বিভাগ থেকে নিয়মিতই আয়োজন করা হয়। জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সি, জাপান বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স, ইন্ডাস্ট্রিসহ জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিভাগের যুক্ততা আছে। শিক্ষার্থীরা ইন্টার্নশিপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গবেষণা ও এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার সুযোগও পাচ্ছে।’

জাপান বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি। উন্নত দেশসহ নানা দেশের ৮৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানিজ স্টাডিজ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষিতে জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কে কৌশলগত উন্নয়ন ঘটছে। দাতা সংস্থা হিসেবে জাপানের ভূমিকা এখন অনেক বিস্তৃত হয়েছে। তিন শর বেশি জাপানি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কাজ করছে। জাপানি বিভিন্ন বৃত্তি ও আর্থিক সাহায্য আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ করে দিচ্ছে। জাপানে আমাদের দেশের তরুণদের চাকরির সুযোগও আছে। জাপানি ভাষা, সংস্কৃতি ও আর্থসামাজিক নানা বিষয়ে পাঠদানসহ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বিভিন্ন বিষয়কে উপজীব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগ শিক্ষার্থীদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলছে।
ড. আব্দুল্লাহ-আল-মামুন, চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক, জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

উচ্চতর শিক্ষা ও বৃত্তির সুযোগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানিজ স্টাডিজ বিষয়ে উচ্চশিক্ষার পর শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ পাচ্ছেন। জাপানিজ স্টাডিজ কোর্সের শিক্ষার্থীরা জাপান সরকারের মনবশু বৃত্তিসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা ও ফেলোশিপের সুযোগ পাচ্ছেন। বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফরিদা ইয়াসমীন বলেন, ‘আমাদের ব্যাচের ৫ জন শিক্ষার্থী এরই মধ্যে ২০২৩ সালে জাপানের মনবশু বৃত্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এ ছাড়া জাপানসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গবেষণায় যুক্ত আছে অনেকেই।’

ভবিষ্যতের পেশা ও সুযোগ

বাংলাদেশে বিশেষভাবে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ-আল-মামুন বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে এটি স্থাপন করা হয়েছে। পুরো অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলে এখানে আনুমানিক ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতা (ওডিএ) কর্মসূচির আওতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উন্নয়ন সহযোগিতা দিয়ে আসছে জাপান। বর্তমানে জাপানি ওডিএর সবচেয়ে বড় গন্তব্য বাংলাদেশ। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, মেট্রো ও পাতালরেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতুসহ নানা উন্নয়ন খাতে জাপান সরকার ও জাপানি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। বাংলাদেশের তরুণ পেশাজীবীরা এসব কাজে যুক্ত হচ্ছে। জাপানিজ স্টাডিজের শিক্ষার্থীরা এসব কর্মসূচিতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে বিশেষভাবে। নির্বাহী ও পরামর্শক হিসেবে কাজের সুযোগ আছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে জাপানে দক্ষ পেশাজীবী নিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে।’