নারকো টেস্টের মাধ্যমে কীভাবে অপরাধীর কাছ থেকে তথ্য জানা হয়?

অনেক অমীমাংসিত ঘটনার রহস্য জানতেই নারকো টেস্ট করা হয় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে
ছবি: পেক্সেলস

১৯৯৫ সাল। প্রেমিকাকে হত্যার অভিযোগে আন্দ্রেস ইংলিশ-হাওয়ার্ড নামের এক মার্কিন তরুণকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিন্তু প্রেমিকা অ্যান্ড্রিয়া ওডনেলের হত্যার বিষয়টি কিছুতেই আদালত বা পুলিশের কাছে স্বীকার করছিল না আন্দ্রেস। সন্দেহভাজন আন্দ্রেসকে অনেকভাবে প্রশ্ন করা হলেও বারবার সে শুধু একটা কথাই বলছিল, তার স্মৃতিতে কিছু নেই। কোকেন গ্রহণের কারণে অনেক কিছুই তখন আন্দ্রেসের মনে থাকত না। পুলিশও অন্য কোনো উপায়ে এই হত্যার কূলকিনারা করতে পারছিল না। শেষে আদালতের অনুমতি নিয়ে নারকো টেস্টের আশ্রয় নেয় তারা। ওষুধের প্রভাবে প্রেমিকাকে হত্যার বিষয়টি আর গোপন রাখতে পারেনি আন্দ্রেস। জানা যায়, রাগের মাথায় সে প্রেমিকাকে হত্যা করেছিল। পরে জেলে আত্মহত্যা করে আন্দ্রেস। এমন অনেক অমীমাংসিত ঘটনার রহস্য জানতেই নারকো টেস্ট করা হয়। এটি ট্রুথ সিরাম নামেও পরিচিত। বিভিন্ন সিরিজ বা সিনেমায় হরহামেশাই এই পরীক্ষা করতে দেখা যায়। বাস্তবেও অপরাধের তথ্য জানতে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এই পরীক্ষাটি করে থাকেন। এই পরীক্ষায় বিশেষ ধরনের একটি ওষুধ অপরাধীর শিরায় প্রবেশ করানো হয়। ওষুধ প্রবেশ করানো ব্যক্তিটি পুরোপুরি অজ্ঞান না হলেও কিছুটা চেতনা হারিয়ে ফেলেন। এ অবস্থায় অপরাধীকে একের পর এক প্রশ্ন করা হয়। নিজের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ থাকে না বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তখন সত্য চেপে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

এই পরীক্ষায় সোডিয়াম পেন্টোথাল, স্কোপোলামাইন ও সোডিয়াম অ্যামাইটাল নামের ওষুধ ব্যবহার করা হয়

প্রাচীন রোমেও অ্যালকোহল পান করিয়ে তথ্য জানার চেষ্টা করা হতো। আধুনিক সময়ে ১৯০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি ফৌজদারি মামলায় প্রথম ট্রুথ সিরামের ব্যবহার হয়েছিল। অনেক বিতর্ক থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বেশ কিছু দেশে এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে দেখা যায়। নিয়ম অনুযায়ী, নারকো টেস্ট করার জন্য ব্যক্তির সম্মতি আবশ্যক। গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ ও মামলার সমাধানের জন্য অপরাধী বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির ওপরে এই টেস্ট করা হচ্ছে। কোনো অপরাধের ঘটনায় প্রমাণ দুর্বল বা অস্পষ্ট হলে তদন্তকারী সংস্থা এই পরীক্ষাটি করে। এই পরীক্ষায় সোডিয়াম পেন্টোথাল, স্কোপোলামাইন ও সোডিয়াম অ্যামাইটাল নামের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। উদ্দিষ্ট ব্যক্তির লিঙ্গ, বয়স, স্বাস্থ্য ও শারীরিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয় ডোজ। ওষুধ দেওয়ার পরে অপরাধীর মধ্যে ঘুমের মতো অবস্থা তৈরি হয়। ব্যক্তিটি এ সময় সম্মোহিতের মতো হয়ে যায়। তার স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে। পুরোপুরি জ্ঞান না হারিয়ে কিছুটা অবচেতন ভাব আসে কিন্তু চেতনা সক্রিয় থাকে। সিরাম নেওয়া ব্যক্তিটির তখন আর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তাই তথ্য চেপে রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ে।

এই পরীক্ষায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্মতি বাধ্যতামূলক

ভারতে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা মামলা, আবদুল করিম তেলগি জাল স্ট্যাম্প পেপার কেলেঙ্কারি, ২০০৭ সালে নিথারি হত্যা মামলা, মুম্বাইতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় আজমল কাসাবের ওপর ট্রুথ সিরাম প্রয়োগ করেছিল কর্তৃপক্ষ। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে, কোনো ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া নারকো বিশ্লেষণ, ব্রেন ম্যাপিং ও পলিগ্রাফ পরীক্ষা করা যাবে না। এ ধরনের পরীক্ষার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করা এক আবেদনের জবাবে বলা হয়, এমন পরীক্ষা বেআইনি ও ব্যক্তিস্বাধীনতার লঙ্ঘন। নারকো অ্যানালাইসিস টেস্টের সময় দেওয়া বিবৃতি আদালতে গ্রহণযোগ্য নয়। কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মামলার ঘটনা ও প্রকৃতি বুঝে এই পরীক্ষার অনুমতি দেন আদালত।

আদালতের আদেশের পর সরকারি হাসপাতালে এই পরীক্ষা পরিচালনা করা হয়। পরীক্ষার সময় প্রথমে তদন্তকারী কর্মকর্তা চিকিৎসকদের ব্রিফ করেন। এপর মনোবিজ্ঞানী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেন। বিশেষজ্ঞরা সন্দেহভাজন ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে পরীক্ষা সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করে। এই পরীক্ষায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্মতি বাধ্যতামূলক। যখন মনোবিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, সন্দেহভাজন ব্যক্তি পরীক্ষা সম্পর্কে বুঝতে পেরেছেন, এপরেই পরীক্ষার প্রক্রিয়া শুরু হয়। চিকিৎসকদের উপস্থিতিতে তদন্তকারী সংস্থা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এই পর্যায়ে ভিডিওতে সবকিছু ধারণ করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা রিপোর্ট তৈরি করেন। ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির কর্মকর্তারা পুরো কাজটি তত্ত্বাবধান করেন।

সূত্র: এনডিটিভি ও কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির সায়েন্স অ্যান্ড সোসাইটি