১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন মোশাররফ শাহ। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে কী বললেন তিনি?
নতুন পরিস্থিতি ও পরিবেশে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছি। আমার মূল উদ্দেশ্য আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা। এত দিন সুশাসন ছিল না, এ কথাটা আমরা বলেছি। ১৯ তারিখ দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম সব পদ খালি। আমার টার্গেট ছিল যেভাবে হোক বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব এটি করতে হবে। কারণ, শিক্ষার্থী না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় মরুভূমি। পরে প্রক্টরিয়াল বডি থেকে শুরু করে প্রাধ্যক্ষ, আবাসিক শিক্ষক নিয়োগ ও হলে আসন বরাদ্দ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছি।
এত বড় একটা আন্দোলন গেল, অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে ক্ষোভ আছে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর কোনো ধরনের ‘মব জাস্টিস’ যেন না হয়, এ ব্যাপারে আমরা সতর্ক ছিলাম। এ কারণে দ্রুত ‘সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা উন্নয়ন’ নামে কমিটি গঠন করেছি। আমরা বলে দিয়েছি, আইন কারও হাতে তুলে নেওয়ার দরকার নেই। কোনো ছাত্র বা শিক্ষকের যদি ক্ষোভ থাকে, প্রমাণ থাকে, তাহলে ওই কমিটির কাছে অভিযোগ দিক। স্বস্তির বিষয় হলো, কমিটি গঠনের পর কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেনি।
আমাদের কাজই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার। আমি সংস্কৃতি বদলানোর চেষ্টা করেছি। প্রতিটি অনুষ্ঠান ও সভা নির্ধারিত সময়ে শুরু করেছি। কারণ, সময়ের মূল্য আছে। এখন সবাই সময়মতো আসেন। সব জায়গায় অটোমেশনের কাজ চলছে। ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার জন্য যে লাইন, সেটি জাদুঘরে যাবে। বই কিনতে শিক্ষার্থীদের যেন দূরে যেতে না হয়, সে জন্য অন–ক্যাম্পাস বুক স্টোর হবে। এটি টিএসসির আদলে বানানো হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য ইনডোর গেম, পড়ার জায়গা ও প্রাক্তনদের জন্য আলাদা ফ্লোর থেকে শুরু করে দৃষ্টিনন্দন অনেক আধুনিক সুবিধা থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, এটি রাজনৈতিক কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক ইমেজ বেড়ে একাডেমিক ইমেজ কমে গেছে। এই ইমেজ বাড়াতে হবে। আগে বাইরে গেলে গর্ব করে বলতাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। বলতাম জামাল নজরুল ইসলাম, আব্দুল করিম ও আনিসুজ্জামানের নাম। এখন বলার মতো কাউকে পাওয়া যায় না। তাঁদের জায়গাগুলো আমাদের তরুণেরা পূরণ করতে পারেননি।
র্যাঙ্কিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ভালো অবস্থানে থাকবে, এটা অনেক দিনের আকাঙ্ক্ষা। কিছু কিছু জায়গায় ভালো কাজ হচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের শিক্ষকেরা শীর্ষ বিজ্ঞানী ও গবেষকের তালিকায় ঠাঁই পাচ্ছেন। কিন্তু বাকিগুলোর অবস্থা ভালো নয়। গবেষণার বিষয় তো পরে, নিয়মিত পাঠদানের বিষয়টিও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। ক্লাস শুরুর পর হঠাৎ হঠাৎ বিভাগগুলো পরিদর্শনে যাব। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলব। রুটিন অনুযায়ী ক্লাস না হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুরোধ করে বলেছি, আপনারা শুধু আমার জন্য একটি কাজ করবেন, আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্বটা আপনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করবেন। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর সংকট থাকবে না।
অধিকাংশ শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতি চান না। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ মানে এই নয় যে শিক্ষার্থীদের কোনো সংগঠন থাকবে না। অবশ্যই সংগঠন থাকবে। তাঁরা জাতীয় দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিক যে রাজনীতি, সেটা ক্যাম্পাসে করবেন না। তাঁরা একাডেমিক স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতি করবেন। ‘আমার পরীক্ষা সময়মতো হলো না কেন, জবাব চাই, জবাব চাই’, এটা হতে পারে একজন শিক্ষার্থীর স্লোগান। আমার ক্যাম্পাসে সেশনজট কেন, ক্লাস সময়মতো হলো না কেন, এসব প্রশ্ন তাঁরা তুলবেন। আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ, বিএনপি জিন্দাবাদ, জামায়াতে ইসলামী জিন্দাবাদ, এসব স্লোগান হবে না। দাবিদাওয়া হবে একাডেমিক স্বার্থকেন্দ্রিক। অক্সফোর্ড, এমআইটি ও হার্ভার্ড থেকে শুরু করে সব জায়গায় ছাত্রদের সংগঠন রয়েছে। তাঁরা কি অমুক পার্টি, তমুক দলের নামে স্লোগান দেন?
আবারও বলছি, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে যোগ্য গ্র্যাজুয়েট তৈরির কারখানা। এটা নেতা তৈরির কারখানা নয়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট দেখেন, সেখানে কি যোগ্য নেতার অভাব আছে? তাহলে আমরা পারব না কেন? আমরা যদি যোগ্য গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে পারি, তাহলে আপনা–আপনিই যোগ্য নেতাও তৈরি হবে।