ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গে চলছে নানা আলাপ। শিক্ষার্থীরা কী বলছেন?
মুস্তাহিদ রিয়াদ, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
‘রাজনীতি আপনার জীবন নিয়ন্ত্রণ করে, তাই আপনি আপনার রাজনীতি নির্ধারণ করুন’—এই বাক্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দেয়ালে লেখা। অথচ এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্ররাজনীতির নামে বিগত ১৫ বছর ধরে চলেছে সীমাহীন অত্যাচার, জুলুম ও কর্তৃত্ববাদ। ফলস্বরূপ, ছাত্ররাজনীতি আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছে এক দুঃস্বপ্নের নাম। ছাত্ররাজনীতির যে প্রথাগত রূপ বাংলাদেশে প্রচলিত আছে, তা কোনো শিক্ষার্থীর জন্য সুফল বয়ে আনবে না। তাই বলে বিরাজনৈতিকীকরণও সমাধান হতে পারে না। বিরাজনৈতিকীকরণ ফ্যাসিবাদের অন্যতম হাতিয়ার। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য ‘আই হেট পলিটিকস’ বলার সংস্কৃতি ফ্যাসিস্টরাই তৈরি করে। ছাত্ররাজনীতির প্রতি আমাদের যে অবিশ্বাস জন্মেছে, তা দূর করার জন্য বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে—সুস্থ ধারার শিক্ষার্থীবান্ধব রাজনীতিতে ফিরে আসা। গ্রুপভিত্তিক নেতা বানিয়ে প্রটোকল দেওয়া, পোস্টারে ক্যাম্পাস ছেয়ে ফেলা—এসব শিক্ষার্থীরা চান না; রাজনৈতিক দলগুলোর এগুলো বোঝা উচিত। এ ক্ষেত্রে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ করে ‘ছাত্র সংসদ চালু’ একটা দারুণ সমাধান হতে পারে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, ২৯ বছর পর ডাকসু নির্বাচন হলেও সেই শিক্ষার্থী সংসদ গেস্টরুম-গণরুম সংস্কৃতি বন্ধ করতে পারেনি, সীমাহীন নিপীড়ন-অত্যাচার থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে পারেনি। কাজেই শিক্ষার্থী সংসদ হলেও সেটার কাঠামোতে সংস্কারের প্রয়োজন আছে।
মাহিন সুলতানা, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকা উচিত। তবে সেটি লেজুড়বৃত্তিক নয়, ছাত্র সংসদভিত্তিক হতে হবে বলে আমি মনে করি। সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আমরা লেজুড়বৃত্তিক নোংরা রাজনীতির বীভৎস রূপ দেখেছি। অনেকে প্রশ্ন তোলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি না থাকলে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেবে কারা?’ তাঁদের কাছে উল্টো প্রশ্ন রাখতে চাই, গত ১৫ বছরের ছাত্ররাজনীতিতে কতজন নিষ্ঠাবান, বিচক্ষণ নেতা ছিলেন? বরং লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির কারণে ক্যাম্পাসে সহিংসতা, হাঙ্গামা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে হলে তৈরি করা হয় পলিটিক্যাল ব্লক। গড়ে ওঠে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদকদ্রব্যের ব্যবসা। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে শুধু নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তাই-ই নয়, নিজের সিটে উঠতেও হাজার টাকা গুনতে হয়। তাহলে ক্যাম্পাসে কি ছাত্ররাজনীতি থাকবে না? থাকবে। আপনার বিপক্ষে যদি কথা বলার মানুষ না থাকে, আপনি প্রাকৃতিকভাবেই স্বৈরাচার হয়ে উঠবেন। কিন্তু সেই রাজনীতি কোনো সংগঠন বা দলের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি হওয়া যাবে না। ছাত্রদের জন্য থাকবে ছাত্র সংসদ; যা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করবে, বিভিন্ন দাবি নিয়ে কথা বলবে। গণতন্ত্র চর্চা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা স্বৈরাচারী মনোভাব থেকে দূরে থাকবে। অন্যের ওপর জুলুম করার পরিবর্তে কীভাবে সাধারণ ছাত্রদের জনকল্যাণমূলক কাজ করতে আকৃষ্ট করতে হয়, তার চর্চা সেখানে হবে। একটি সুষ্ঠু শিক্ষার্থীবান্ধব রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরিতে ছাত্র সংসদের কোনো বিকল্প নেই।
মো. মোস্তফা আমীর ফয়সাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি থাকবে, নাকি থাকবে না; থাকলে কীভাবে থাকবে—এই ব্যাপারটি কোনো ঐশ্বরিক আইন নয়। পরিবেশ, পরিস্থিতিভেদে ওই সময়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাই এটি নির্ধারণ করবেন। গত আগস্টে ঢাকা মেডিকেল কলেজে সব ধরনের লেজুড়বৃত্তিক, সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। প্রতিটি ব্যাচে শিক্ষার্থীদের সরাসরি ভোটে একটি ‘প্রতিনিধিদল’ গঠন করা হয়। ক্যাম্পাস, হল সংস্কার থেকে শুরু করে সব কাজে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে তারা যেভাবে এগোচ্ছে, তা প্রমাণ করে ছাত্রদের জন্য কাজ করতে হলে সাংগঠনিক রাজনৈতিক পরিচয় থাকতে হবে—এটা একটা ডাহা মিথ্যা অজুহাত। আমার মনে হয় আমাদের ক্যাম্পাস এখনো ঠিক পথে এগোচ্ছে। এই ইতিবাচক পরিবর্তনকে ধরে রাখতে হবে। প্রতিনিধিদের সব কার্যক্রমের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, নির্দিষ্ট সময় পর আবার প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে। সব ধরনের ক্লাবকে সক্রিয় করে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের দরকার নেতৃত্ব, যার জন্য ছাত্ররাজনীতি আবশ্যক নয়। দেশের মূলধারার রাজনীতির ইতিবাচক ও গঠনতান্ত্রিক পরিবর্তন সাপেক্ষে ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীরা যদি মনে করেন ছাত্ররাজনীতি প্রাসঙ্গিক; তখন তাঁরা নতুন করে সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে রাতারাতি পরিবর্তন আসবে না। এ জন্য আমাদের আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। আর ভবিষ্যতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যাঁরাই আসুন না কেন, প্রশ্ন করার সংস্কৃতি চালু রাখতে হবে। আমরা এক দানবের শেষে আরেক দানবের উত্থান দেখতে চাই না।