একটা এ-ফোর আকারের কাগজ মা-বাবা বাঁধাই করে রেখেছিলেন যত্নে। লেমিনেটিং করা সেই কাগজের মহত্ত্ব বুঝলাম একটু বড় হয়ে। সেখানে লেখা আমার জন্মতারিখ, জন্মবার আর জন্মের সময়। বড় হতে হতে আরও জানলাম, আমি সেই বিরলতম মানুষদের একজন, যার জন্মদিন আসে চার বছর পরপর! কারণ, আমি জন্মেছি লিপ ইয়ারে।
তখন স্কুলে পড়ি। গ্রামে মাঝেমধ্যে দৈনিক পত্রিকা আসে। পত্রিকা হাতে পেলে চোখ বোলাই রাশিফল বিভাগে। এরপর গুণী মানুষের জন্মদিন নিয়ে যে বিভাগটা থাকত, মনোযোগ দিয়ে পড়তাম সেটা। মনে মনে খুঁজতাম কোন গুণী মানুষের জন্ম ২৯ ফেব্রুয়ারি! একদিন পড়ছিলাম খ্যাতিমান অভিনেতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদের জন্মদিন নিয়ে লেখাটা। সেই লেখা পড়ে আমি তো আপ্লুত। কারণ, তাঁর জন্মও ২৯ ফেব্রুয়ারি! পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার যে গ্রামে আমার জন্ম, সেখানে ছোটবেলায় কাউকে জন্মদিন উদ্যাপন করতে দেখিনি। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। জন্মদিন পালন না করলেও ফেব্রুয়ারি মাস এলেই একধরনের ভালো লাগা কাজ করত।
স্কুল-কলেজ পেরিয়ে অনার্স পড়তে খুলনায় যাই। ক্যাম্পাসে নতুন নতুন বন্ধু হচ্ছে। একদিন ক্লাস শেষে এমনই এক বন্ধুর জন্মদিনের আয়োজনে ডাক পড়ল। কেক কাটা হবে। বন্ধুদের আরও অনেকে এল। আমরা অনেকেই অনেকের জন্মদিন জানি না। তাই কেক কাটার আগে কার কবে জন্মদিন, সেটাও জানতে চাওয়া হলো। আমার বলার পালা যখন এল, তখন কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, আমার জন্মদিন ২৯ ফেব্রুয়ারি। সবাই শুনে হো হো করে হেসে উঠল। তারা ভাবল, আমি হয়তো মজা করছি। পরে যখন বুঝতে পারল সত্যিই আমার জন্মদিন লিপ ইয়ারে, তখন থেকে আমার কদর বেড়ে গেল। আমিই নাকি তাদের জীবনে একমাত্র মানুষ, যার জন্ম অধিবর্ষে। এরপর অধীর আগ্রহে দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকল বন্ধুরা। এই বন্ধুদের সঙ্গেই ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো আমি জন্মদিন উদ্যাপন করি।
তারপর আবার চার বছরের অপেক্ষা। ২০১৬ সালেও দিনটি বন্ধুরা রাঙিয়ে তুলল। এটিই আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় জন্মদিন হয়ে আছে। আমি তখন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। শিশুদের নিয়ে কাজ করি। জন্মদিনের সকালেই হাজির হই খুলনার হরিজনপল্লিতে। পল্লির শিশুদের নিয়ে কেক কেটে আমার বিশেষ দিনটি পালন করি। দুপুরেও আরেক দল শিশুর সঙ্গে সময় কাটে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ও জুনিয়রদের সঙ্গে ‘অধিবর্ষ’ উদ্যাপন! সেকি আনন্দময় সময়।
মাঝখানে আবার চার বছরের অপেক্ষার পর ২০২০ সাল। কাঙ্ক্ষিত জন্মদিন এল বটে, সঙ্গে আনল করোনার আভাস। দেশে করোনার কড়াকড়ি না থাকলেও সচেতন মানুষ মানা শুরু করে দিয়েছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে সেই জন্মদিনটা কেটে গেল সহকর্মী আর বন্ধুদের সঙ্গেই। বলতে ভুলেই গিয়েছি, তত দিনে আমি চাকরিজীবনে প্রবেশ করেছি। ব্র্যাকের হয়ে কাজ করি কক্সবাজারে।
আর এবার? ৩২ বছর বয়সে এবার অষ্টম জন্মদিন উদ্যাপন করব। আসছে ২৯ ফেব্রুয়ারি আমার বিবাহিত জীবনের প্রথম জন্মদিন। তবে কাটবে পেশাগত ব্যস্ততায়, পরিবার থেকে দূরে। ইতিমধ্যে স্ত্রীর সারপ্রাইজ উপহার হাতে পেয়ে গেছি। আর কোনো চমক অপেক্ষা করছে কি না, সেটাই সময়ই বলে দেবে!