আদনানের তোলা ৫ ছবির গল্প

আদনান আজাদ অভিনয়শিল্পী ও মডেল। তবে বন্য প্রাণী–আলোকচিত্রী হিসেবেই তিনি পরিচিত বেশি। ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’, ‘বিবিসি আর্থ’ ছাড়াও দেশের প্রায় সব সংবাদপত্রেই ছাপা হয়েছে তাঁর তোলা ছবি। তিনি নিজেও প্রাণী সংরক্ষণে সোচ্চার। আদনানের কাছে তাঁর স্মরণীয় পাঁচটি ছবি তোলার গল্প শুনলেন সজীব মিয়া

হাতি দেখতে শেরপুর

শেরপুরের ভারত সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ে খাবারের সন্ধানে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় হাতির পাল। পরিকল্পনা করলাম হাতি দেখতে যাব। ঢাকা থেকে রাতেই রওনা করলাম। সঙ্গী আরও দুজন। তাঁরাও বন্য প্রাণীর ছবি তোলেন। ভোরে শেরপুর শহরে নাশতা সেরে গারো পাহাড়ের দিকে রওনা হলাম। কয়েক ঘণ্টা পাহাড়ের এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। কিন্তু কোনো হাতির দেখা পেলাম না। রোদের মধ্যে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে মোটামুটি ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। দিনটা এভাবেই কাটল।

শেরপুরে দেখা বুনো হাতি

ঠিক বিকেলে খবর পেলাম, গভীর পাহাড়ে বিশ্রাম নেওয়া হাতির দল নেমে আসছে। পাহাড়েই ছিলাম, আমরা দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম। হাতিগুলো একটা জায়গায় জড়ো হতে লাগল। দেখে তো আমার চক্ষু ছানাবড়া! কক্সবাজারে কয়েকবার বুনো হাতি দেখেছি, বান্দরবানেও দেখেছি, কিন্তু এত দিনে দেখা সব হাতি এক জায়গায় করলেও এর অর্ধেক হবে না! দলটিতে কত হাতি ছিল গুনে দেখিনি, তবে পঞ্চাশের কম হবে না তা হলফ করে বলা যায়। দলে একটি বড় দাঁতাল হাতি ছিল, খুব ক্ষিপ্রতা ছিল তার ভেতরে।

আমরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে প্রাণ ভরে হাতি দেখলাম। ইচ্ছামতো ছবিও তুললাম।

মেছো বাঘের পিছু ১৫ দিন

২০১৪ সালে গিয়েছিলাম শ্রীমঙ্গলের ভাইয়া বিলে। বিলে পাখির ছবি তুলতে গিয়ে মল দেখে বুঝতে পারি আশপাশে মেছো বাঘ আছে। পানিতে মাছ শিকার করতে পারে বলে এই নাম। অনেকে মেছো বিড়ালও বলেন। দারুণ সাঁতারু এই প্রাণী। সে যে শুধু মাছই খায় এমনটা নয়; পাখি, সাপ, ইঁদুর, খরগোশসহ অনেক প্রাণীই আছে তার খাদ্যতালিকায়। এরা সচরাচর ঝোপে লুকিয়ে থাকে। পড়ন্ত বিকেলে করুণ সুরে ডাকে। সন্ধ্যায় বের হয়।

মেছো বাঘ

অবস্থান জানার পর কয়েকবার খালি চোখে দেখলেও আলোর অভাবে ছবি তুলতে পারিনি। এভাবে প্রায় দিনই অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু ল্যান্সের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছিল না। এভাবে পার হয়ে গেল প্রায় ১৫ দিন। একদিন সুবিধাজনক একটি জায়গায় নিজেকে আড়াল করে বসে পড়ি। মেছো বাঘটি হঠাৎ বিকেলে বের হয়। ছবিটা সে সময় তোলা।

ভোঁদড়ের অবাক চাহনি

সুন্দরবনের বঙ্গোপসাগর–ঘেঁষা কটকার একটি খালে ছোট্ট নৌকা নিয়ে চলেছি। মনটা খুব ফুরফুরে। কিছুক্ষণ আগেই এই খালে আলাদা আলাদা চারটি সাপ দেখেছি। ভালো ছবিও তুলতে পেরেছি। তার মধ্যে দুটি পিট ভাইপার, একটি গোখরো, একটি ডগফেস ওয়াটার স্নেক।

ভোঁদড়

টিমের সবাই খুব খুশি। তৃপ্তি নিয়ে লঞ্চে ফিরছি। খাল থেকে যখন বের হচ্ছি, এমন সময় দূর থেকে চারটি ভোঁদড়কে দেখি খালের পাড়ে। কাছে যেতেই তিনটি পালিয়ে যায়। চতুর্থটিও ছুটতে গিয়ে কি ভেবে ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর স্বভাবসুলভ দুই পায়ে দাঁড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে আমাদের দেখতে থাকে। সুন্দর মুহূর্তটি সঙ্গে সঙ্গে আমরা ক্যামেরায় তুলে রাখি।

উড়ুক্কু কাঠবিড়ালি

১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। গভীর রাত। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। লজ্জাবতী বানরসহ নিশাচর প্রাণীর ছবি তোলার পরিকল্পনা নিয়ে বসে আছি। সঙ্গী গবেষক চয়ন ও সাবিত। পাশের উঁচু গাছে আগেই একটি উড়ুক্কু কাঠবিড়ালি দেখেছি। কচি পাতা খাওয়ার সময় বেশ কিছু ছবিও তুলেছি। চয়ন বলছিল, যদি ওড়ার একটা ছবি নেওয়া যেত, জীবনে আর কি চাই! ঘণ্টাখানেক পর কাঠবিড়ালিটি গাছের এক কোনায় চলে এল। আমার ক্যামেরায় ফ্লাশ লাগানো। চোখ ক্যামেরায় রেখে রেডি হয়ে আছি। হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখনই চয়ন বলে উঠল, ‘ভাই, লাফ দেবে।’ বলেই হাতে থাকা সার্চলাইটটা সে কাঠবিড়ালির দিকে ধরল আর বিড়ালিটিও অমনি উড়াল দিয়ে প্রায় ২০০ ফুট দূরের অন্য একটি গাছে গিয়ে পড়ল। অবশ্য এর মধ্যেই আমি ৮ কি ১০টি ক্লিক দিয়ে ফেলেছি। আলোকচিত্রী–জীবনে এটা আমার অন্যতম সেরা ছবি।

উড়ুক্কু কাঠবিড়ালি

উড়ুক্কু কাঠবিড়ালি দেখতে অন্য সব কাঠবিড়ালির মতোই। খাদ্যাভ্যাসও একই। কিন্তু এরা নিশাচর ও বিরল। দিনে গাছের কোটরে ঘুমিয়ে থাকে। রাতে খাবার সংগ্রহ ও অন্যান্য কাজ সারে। উড়তে পারলেও এদের কিন্তু পাখির মতো ডানা নেই। চার হাত-পা যখন মেলে, তখন বোঝা যায় সামনের হাত থেকে পেছনের পা পর্যন্ত পর্দা লাগানো, স্বাভাবিক অবস্থায় যা বোঝা যায় না। এরা উঁচু গাছ থেকে যখন চার হাত-পা মেলে লাফ দেয়, তখন কিছুক্ষণ শূন্যে ভাসতে পারে। ভেসে কয়েক শ ফুট দূরত্বে অন্য গাছে গিয়ে পড়ে, যাকে বলে গ্লাইড। সিলেট বিভাগীয় বন ও পার্বত্য অঞ্চলের বনাঞ্চলে এদের দেখা যায়।

বাংলার বাঘ আমি দেখিয়াছি

এ বছর একটি লক্ষ্য নিয়েছিলাম, বাঘের ভালো ছবি তুলবই তুলব! কারণ, আগে যে কয়েকবার সুন্দরবনে বাঘের ছবি তুলেছি তা দূর থেকে, ততটা মানসম্মতও হয়নি।

সুন্দরবনে বাঘ

লক্ষ্য পূরণে বন্ধু তানজির রুবেলের সঙ্গে পরিকল্পনা করে সুন্দরবনে টানা সাতটি ট্যুর করি। চতুর্থ ট্যুরে খুব কাছ থেকে একটি কিশোর বাঘ দেখলেও ছবি তুলতে পারিনি। বাঘের ছবি তোলার আফসোস তাই কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সপ্তম ট্যুরে প্রথম দুই দিন উল্লেখযোগ্য কিছুই পেলাম না। একদিন পর থেকে রোজা, আমরা আর সুন্দরবনে থাকতে পারব না। তৃতীয় দিন বিকেলে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চেপে কটকার একটি খাল দিয়ে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর সামনে বসা তানজির রুবেল ‘বাঘ! বাঘ!’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে। দেখি গাছের একটি ডালে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে একটি বাঘ।

ব্যস আর কি দরকার? একসঙ্গে গর্জে উঠল সবার ক্যামেরার শাটার। এত কাছ থেকে বাঘের ছবি পেয়ে সবার হাসিমুখ।