আমাদের আহ্বানে ভালোবাসার টক–ঝাল–মিষ্টি গল্প লিখে পাঠিয়েছেন পাঠক। ‘ছুটির দিনে’তে পর পর দুই সংখ্যায় ছাপা হওয়ার পর বাছাই আরও একটি লেখা প্রকাশিত হলো প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে।
সবে উকিল হয়েছি। ছাত্রত্বের গন্ধ এখনো শরীর থেকে যায়নি। চলনে-বলনে গাম্ভীর্যের মাত্রা কম। গ্রামের বাড়ি থেকে ভোরে জেলা সদরের দিকে ছুটতে হয়। আবার বিকেলে ফিরে, সন্ধ্যার আগে স্থানীয় বাজারে আড্ডা দিই। এক চিকিৎসক বন্ধুর ডিসপেনসারি আড্ডা দেওয়ার জায়গা।
সেই ডিসপেনসারিতে বসেই একদিন চা পান করছি। আচমকা এক লম্বা মধু রঙের অপূর্ব সুন্দরী ডিসপেনসারিতে এল। পরনে গোলাপি সালোয়ার-কামিজ, গলায় গোলাপি গলাবন্ধ। চুলগুলো দারুণ মসৃণ, মাথার একদিক ঢেকে আছে। মায়াবী মুখ। অসাধারণ চোখে বলল, ‘চিকিৎসক কই?’
আমি আমার ভেতর তখন বহু বহু যুগের পরিচিত কাউকে খুঁজছিলাম। আমি সম্মোহিত। অপলক আমার চোখ!
চিকিৎসক বন্ধু তখন আগরবাতি কিনতে গেছে। আসতে দেরি হবে বুঝতে পেরে মেয়েটা চলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো, কে যেন স্বর্গ থেকে নেমে এসে আবার চলে গেল। হৃদয়ে শুরু হলো হাহাকার। কেমন যেন অস্থির অস্থির করতে থাকে বুক!
তখন ২৮ বসন্ত চলছে। বসন্তের শীতোষ্ণ হাওয়া কাকে যেন খুঁজছিল! মনে হলো এ–ই সে। আমি স্থির থাকতে পারি না। কাউকে কিছু বলা যায় না। এ মেয়ে তো স্থানীয় নয়, কী করি–কী করি অবস্থা!
দুদিন পর সকালে রিকশায় করে কোর্টের উদ্দেশে রওনা দিয়েছি, পথে রাস্তার পাশে দেখি সেই মেয়ে! একটা বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি ছাঁটের কামিজ পড়েছে। সকালের সোনা রোদে তার শরীরের ঔজ্জ্বল্য আরও বেড়েছে। চলমান রিকশায় যতটা দেখা যায়, তাকে দেখলাম!
আদালতে মন বসে না। তাকে দেখতে বিকেলের মধ্যেই চলে এলাম। আশ্চর্য! বাসস্ট্যান্ডে নেমেই তার সঙ্গে দেখা। সে তখন কোথাও রওনা দিয়েছে। তার পাশের লাগেজ দেখে বোঝা যায়, বেশ দূরের পথ। আমাকে দেখে সে উচ্ছ্বসিত। চোখ জোড়া খুব চঞ্চল। আমার চোখের ভাষা সে তাহলে পড়তে পেরেছে!
বাস আসতে একটু দেরি হওয়ার সুযোগে সে কৌশলে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, ‘গোপালগঞ্জ এখান থেকে ১৫০ কিলোমিটার। যদিও বাসস্ট্যান্ডের কাছেই বাসা, তবু অনেক রাত হয়ে যাবে। আমি শিলা; কোনো কিছু পরোয়া করি না। কিন্তু দুশ্চিন্তা তো আছেই...’
মানে তার নাম শিলা? নাম শুনে কী যে আনন্দ! ভাবলাম একটু আলাপ করি, কিন্তু বাস চলে আসায় সে সুযোগ আর হলো না। যতটা পারা যায়, তার চলে যাওয়া বাসটা দেখছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, সে জানালা দিয়ে হাতের ইশারায় বলছে, বাই!
বেশ কিছুদিন পর ঝোঁকের বসে গোপালগঞ্জগামী বাসের উদ্দেশ্যে ছুটলাম কমফোর্ট লাইন কাউন্টারে। গাড়ি আর সিট দুটোই পেলাম। গাড়ি ছুটছে। ১৫০ কিলোমিটার পথ। গোপালগঞ্জে কোনো দিন যাইনি। তারপরও কী এক অনিবার্য টানে মন-প্রাণ ছুটতে থাকে। সেই প্রিয় মুখ, চোখ; বারবার মনে ভেসে ওঠে আর ভাবি, দেখা পাব তো?
মনের আয়নায় ভেসে ওঠা কালো চোখ দুটো মনে হয় বলছে, ‘তাড়াতাড়ি চলে এসো।’
রাত দশটায় বাস গোপালগঞ্জে থামল। অচেনা শহর! তথ্য শুধু একটা নাম—শিলা!
এক বৃদ্ধ চা–দোকানি চা বানাচ্ছেন। এককাপ চা চাইলে তিনি দিলেন। খানিকটা আলাপের পর সুযোগ বুঝে শিলার নামটা বললাম। দোকানি ঝানু লোক। বুঝলেন সব। তবে কিছু সময় পর দক্ষিণের দুই বাসা অন্তর রাসমোহনবাবুর বাসাটা দেখিয়ে বললেন—ওইটা।
রাত অনেক হয়েছে। তবে গেট তখনো বন্ধ হয়নি। ধকধক বুকে ভেতরে ঢুকলাম। দেখি বারান্দায় এক লোক সিগারেট ফুঁকছে। চেহারায় জামাই জামাই ভাব। আমি দাঁড়ালাম। সহসা সেই মধু রঙের মোহিনী শিলা এসে পড়ল। নববধূর সাজ, হাতে শাঁখা, কপালে সিঁদুর।
আমি মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেলাম।
আদরের কমতি হলো না। রাত বারোটার ফিরতি নাইট কোচে যখন উঠব, পেছন থেকে একটু সুযোগ পেয়ে শিলা বলল, ‘আর কয়টা দিন আগে আসতে পারলেন না?’