আংটিবদলের চল কি এভাবেই?

মানুষের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়ের নাম বিয়ে। বিয়ের সঙ্গে শুধু দুটো মানুষ নন, জড়িয়ে থাকে দুটি পরিবারের মেলবন্ধনের গল্প। আচার-আনুষ্ঠানিকতায় ভরপুর নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধা পড়ে দুটি পরিবার। আর এই বিশাল আয়োজনের সূচনা হয় আংটিবদল দিয়ে।

আংটিবদলের আয়োজন দিয়ে শুরু হয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। মডেল: হৃতিকা ও সৌরভ অভি, আংটি: ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, পোশাক: সাফিয়া সাথী, সাজ: অরা বিউটি লাউঞ্জ
ছবি: কবির হোসেন

পারিবারিকভাবে ঠিক করা হোক কিংবা প্রেমের, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় আংটিবদল দিয়ে। অথচ কয়েক বছর আগেও আংটিবদলের আয়োজনটি নিয়ে বিশেষ ভাবনা দেখা যেত না এ দেশে। বেশির ভাগ সময়ই আংটিবদল হতো খুবই ঘরোয়াভাবে। কনে দেখার যে আয়োজন হতো, সেখানেই আংটি পরিয়ে দিতেন গুরুজন ধরনের কেউ। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এখানেও এসেছে নতুনত্ব। আংটিবদল এখন বসার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। অনেক মানুষ নিয়ে মহাসমারোহে আয়োজন করা হয় আংটিবদলের অনুষ্ঠান। আজকাল তো বিয়ের অনুষ্ঠানের বিশেষ পর্ব হয়ে উঠেছে আংটিবদল পর্বটি। কিন্তু কীভাবে এল বিয়েতে আংটিবদলের রীতি? কেন বাঁ হাতের অনামিকায় পরানো হয় বিয়ের আংটি?

যেভাবে এল আংটি

‘উইল ইউ ম্যারি মি?’ মডেল: হৃতিকা ও সৌরভ অভি

আংটিবদলের আংটি সব বিবাহিত জুটির কাছেই বেশ আবেগঘন একটি গয়না। এই আংটির হাতবদল দিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে দুজনের একসঙ্গে পথচলার ঘোষণা আসে। শুধু উপমহাদেশে নয়, পুরো বিশ্বেই রয়েছে আংটিবদলের রীতিনীতি। এর সূচনা হয়েছিল প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায়। প্রায় একই সময় রোমেও ছিল আংটি পরার চল। তবে দুই সভ্যতায় আংটিকে দেখা হতো পুরোপুরি ভিন্ন রূপে। মিসরীয় সভ্যতায় আংটি ছিল সুস্বাস্থ্যের প্রতীক। তাদের বিশ্বাস ছিল, ‘ভেনা অ্যামোরিয়াস’ অর্থাৎ প্রেমের শিরা বাঁ হাতের অনামিকা থেকে হৃৎপিণ্ডে গিয়ে ঠেকেছে। অর্থাৎ বাঁ হাতের অনামিকায় আংটি পরানোর মাধ্যমে একেবারে হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছে। হাতের আংটি গোল করার চলও তারাই করেছে। শুধু হাতের আঙুলের সঙ্গে মানানসই বলে নয়, গোল করার পেছনেও ছিল তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা। প্রতিটি আকৃতি যেমন ত্রিভুজ বা চতুর্ভুজেরই শুরু ও শেষ থাকে। একমাত্র বৃত্তেরই শুরু বা শেষ নেই। তেমনিভাবে কারও অনামিকায় আংটি পরিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো, অন্ততকাল ধরে তাঁর হৃদয়ে নিজের অবস্থান স্থায়ী করে নেওয়া।

কারও হাতে আংটি পরিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো, তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব জানানো

অন্যদিকে গ্রিক সভ্যতায় আংটির প্রচলন ছিল মালিকানা সূত্রে। কোনো নারীর হাতে আংটি থাকা মানেই ছিল তিনি কোনো না কোনো পুরুষের সম্পত্তি। প্রথম প্রথম এই আংটি তৈরি করা হতো হাতির দাঁত, রংবেরঙের পাথর, তামা কিংবা লোহা দিয়ে। কিছুদিন পরই শুরু হয় সোনার চল। প্রথম আংটি হিসেবে সোনার ব্যবহার দেখা যায় ‘দ্য লস্ট সিটি’খ্যাত পম্পেইতে। বিভিন্ন সভ্যতায় আংটির প্রচলন থাকলেও বিয়ে কিংবা আনুষ্ঠানিকতার প্রমাণ হিসেবে আংটির প্রচলন খুব বেশি দিনের নয়। অষ্টম শতকে প্রথম পোপ নিকোলাস ঘোষণা করেন, এখন থেকে আংটি ব্যবহৃত হবে প্রমাণপত্র হিসেবে। কারও হাতে আংটি পরিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো, তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব জানানো। এর পর থেকেই বিয়েতে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে আংটি।

পরিবর্তনের ধারায় আংটি

বিয়ের আংটি হিসেবে আজকাল হীরার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। মডেল: হৃতিকা

একটা সময় পর্যন্ত বিয়ের আংটিতে একচেটিয়া সোনারই প্রচলন ছিল। কিন্তু বিয়ের আংটি হিসেবে আজকাল হীরার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এই প্রচলনও কিন্তু খুব বেশি দিন আগের নয়। ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যায় যে আংটি হিসেবে হীরার প্রথম ব্যবহার ১৪৭৭ সালে। অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ম্যাক্সিমিলিয়ন তাঁর স্ত্রী মেরি অব বুরগান্ডির হাতে পরিয়ে দেন হীরার আংটি। সেই আংটিতে খোদাই করা ছিল দুজনের নামের অদ্যাক্ষর—এম। তখনো আংটি হিসেবে সোনার জনপ্রিয়তাই ছিল বেশি। হীরার আংটি জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর। আফ্রিকার খনিতে বিপুল পরিমাণ হীরার খোঁজ পায় ব্রিটিশ কোম্পানি ডি বিয়ার্স। প্রচুর পরিমাণ হীরা থাকলেও খুবই সামান্য পরিমাণ হীরা বাজারজাত করত তারা। আর হলিউডের নামীদামি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে হীরাকে দুর্লভ এক অলংকার হিসেবে প্রচার করা শুরু করে তারা। রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে হীরা। প্রেমিকাকে প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া থেকে শুরু করে বিয়ের আসর, সব জায়গায় শুরু হয় হীরার আংটির প্রচলন। ফুলেফেঁপে ওঠে হীরার ব্যবসা, যা চলছে এখনো।

মডেল: সৌরভ অভি

হীরা বা সোনার আংটির জায়গায় এখন আরেকটি ধরন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সেটা হলো নানা রকম রঙিন পাথরের আংটি। হলিউড তারকাদের হাত ধরেই আংটির এই নতুন ধরন জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। ডেডপুল অভিনেতা রায়ান রেনল্ডস বাগ্‌দান সেরেছেন রোজ-গোল্ড পাথরের আংটিতে, কেটি পেরির অনামিকায় ছিল রুবি-স্পার্কলার আর আরিয়ানা গ্র্যান্ডে সেজেছিলেন মুক্তার আংটিতে। তারকাদের এই প্রভাব যে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়েছে, সেটা বোঝা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের বিয়ের ছবি দেখলেও।

গত দশক পর্যন্ত বাংলাদেশও একচেটিয়া সোনার আংটির দখলে ছিল। বিত্তশালী পরিবারের বিয়েতে দেখা মিলত হীরার আংটির। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন অনেক সাধারণ মানুষের বিয়েতেও হীরার আংটি বা নাকফুল দেওয়ার প্রচলন এসেছে। বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড দেশে হীরার গয়না জনপ্রিয় করে তুলেছে। সহজলভ্য ও দামের দিক দিয়ে হাতের নাগালে থাকায় হীরার আংটির জনপ্রিয়তা বাড়ছে।

 সূত্র: ব্রাইডস ডটকম ও ওয়েডিং সলিউশন