হাত-পা বেঁধে পানিতে ছেড়ে দেওয়ার পরও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভেসে থাকতে পারেন, কাটতে পারেন সাঁতার। বস্তাবন্দী অবস্থায়ও দিব্যি ভেসে থাকতে পারেন। পানিতে ভেসে থাকার এসব ব্যতিক্রমী কৌশল কীভাবে রপ্ত করলেন মোসাদ্দেক হোসেন? ৭০ বছর বয়সী এই তরুণের সঙ্গে কথা বলেছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
এই এপ্রিলেরই শুরুর দিকের ঘটনা। হাতকড়া পরে ৭ মাইল সাঁতার কেটে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম ওঠান মিসরের সেহাব আলম। প্রথম আলোয় সেই খবর পড়েই রাজশাহী বারের আইনজীবী গোলাম মওলার মনে পড়ে যায় মোসাদ্দেক হোসেনের কথা। চার বছর আগে পরিচয় হয়েছিল। গল্পে গল্পে তখনই জানতে পারেন মোসাদ্দেক হোসেনের সাঁতার–নৈপুণ্যের কথা। মিসরীয় তরুণ সেহাবের চেয়ে মোসাদ্দেক হোসেনের গল্প আরও বিচিত্র মনে হয়েছে। কিন্তু নিজের চোখে কখনো দেখেননি গোলাম মওলা। শোনা গল্পটা এত দিন পর নিজের চোখে দেখার ইচ্ছা হলো। পরদিনই পদ্মা নদীতে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হলো। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দিব্যি সাঁতার কাটলেন মোসাদ্দেক হোসেন। এই হাত-পা বাঁধা অবস্থায়ই বস্তায় ঢুকিয়ে তাঁকে পানিতে ছেড়ে দেওয়া হলো, তখনো দিব্যি ভেসে থাকলেন।
গোলাম মওলার কাছে এসব ছবি আর ভিডিও দেখে আমার তো চোখ ছানাবড়া। মনে হলো বাস্তবেও একবার দেখতে হয়! মোসাদ্দেক হোসেনকে বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও রাজি হয়ে গেলেন। গত ১৫ এপ্রিল সকালে রাজশাহী নগরের তেরখাদিয়া মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের সুইমিংপুলে তাঁর প্রদর্শনীর আয়োজন করা হলো। সেখানে মোসাদ্দেকের স্ত্রী মমতাজ বেগমও উপস্থিত ছিলেন। সুইমিংপুলে গিয়ে তিনি পানিতে ঝাঁপ দিলেন। সত্যি তাঁর সাঁতার দেখে বোঝা গেল জলক্রীড়া কাকে বলে! তাঁকে পানি থেকে তুলে হাত-পা বেঁধে দেওয়া হলো। ডুবে যান কি না ভেবে উপস্থিত সবারই বুক কাঁপছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল দিব্যি সাঁতার কাটছেন। এরপর তাঁকে ওপরে তুলে একটি প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে হাত-পা বেঁধে বস্তার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হলো। শুধু নিশ্বাস বের হওয়ার জন্য খানিকটা জায়গা কাঁচি দিয়ে কেটে দেওয়া হলো। আবার তাঁকে পানিতে নামানো হলো। এবার সবার মধ্যে আরও ভয়, কী হয় না হয়! কিন্তু তিনি দিব্যি ভেসে থাকলেন। প্রায় ৩০ মিনিট ভেসে থাকার পরে সবাই তাঁকে উঠে আসার জন্য অনুরোধ করলেন। তাঁকে ওপরে তোলা হলো। তারপর পুলে বসেই মোসাদ্দেক হোসেনের সঙ্গে তাঁর সাঁতারজীবনের গল্প শুনলাম।
১২ ঘণ্টা সাঁতার
মোসাদ্দেক হোসেনের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার দাদনচক গ্রামে। রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজের অফিস সহকারী হিসেবে ২০১৬ সালে অবসর নিয়েছেন। বর্তমানে রাজশাহী নগরের তেরখাদিয়া পশ্চিমপাড়ায় স্থায়ীভাবে বাস করছেন। জানালেন, তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে ও ছেলের বউ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা। মেয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা। জামাতা চিকিৎসক।
ছয় বছর বয়সে মোসাদ্দেক হোসেন বাবাকে হারান। চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে মোসাদ্দেক হোসেন দ্বিতীয়। ভাইদের মধ্যে তিনিই বড়। বাবাহীন ছেলেকে শাসন করার কেউ ছিল না। যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতেন। বন্ধুদের সঙ্গে পানিতে নামতেন, সাঁতার কাটতেন। বন্ধুদের সঙ্গে সাঁতার প্রতিযোগিতায় নামলে তাঁদের ৫০ মিটার এগিয়ে যাওয়ার পর তিনি নামতেন। তারপরও তাঁদের পেছনে ফেলে ১০০ মিটার এগিয়ে যেতেন। ১৯৮৩ সালে পদ্মার নদীর একটি চ্যানেলে টানা ১২ ঘণ্টা সাঁতার কেটেছিলেন। এই সময় সাঁতার দেওয়া অবস্থায় শুধু দুধ ও ডিম খেয়েছিলেন। সে সময় তিনি গভীর পানিতে বুক পর্যন্ত ভাসিয়ে প্লেট থেকে খাবার খান।
বাজি থেকে শুরু
১৯৮১ সালের কথা। স্থানীয় এক যুবকের বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়েতে একটি মোটরসাইকেল দাবি করে বসেন তিনি। আদায়পত্র নিয়ে কনেপক্ষের সঙ্গে আলাপের সময় মোসাদ্দেক হোসেনও উপস্থিত ছিলেন। ঠিক হয় মোটরসাইকেল বাবদ ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। বিয়েটা যেন হয়, সেই জন্য কথায় কথায় মোসাদ্দেক হোসেন বলেছিলেন, ১৫ হাজার টাকায় মোটরসাইকেল পাওয়া না গেলেও সমস্যা হবে না।
কিন্তু পরে দেখা গেল ১৫ হাজার টাকায় আর মোটরসাইকেল পাওয়া যাচ্ছে না। দাম বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১৯ হাজার টাকা। মোটরসাইকেল না পেলে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিলেন ওই যুবক। তখন মোসাদ্দেক হোসেনের কাছে এসে মেয়ের বাবা কাকুতিমিনতি করে বলেন, সমস্যা হবে না বলেছিলেন। বাধ্য হয়ে বাকি সাড়ে ৪ হাজার টাকা তিনি নিজ থেকে দিয়ে বিয়ে দেন। তখনকার দিনে একজন বেকার ছেলের কাছে এই পরিমাণ টাকা মানে অনেক টাকা। ধার করে দিয়েছিলেন। ভাবলেন, একটা বাজি ধরে এই টাকা ওঠানো যায় কি না। তিনি ঘোষণা দিলেন কেউ তাকে ৫ হাজার টাকা দিলে হাত–পা বাঁধা অবস্থায়ও তিনি সাঁতার কাটতে পারবেন। আর না পারলে সেই টাকা দেবেন। তবে ঘোষণাটা দেওয়ার আগে গোপনে একটু অনুশীলন করে নিলেন। কারণ, আগে কখনো তিনি এভাবে সাঁতার কাটেননি। দেখলেন তিনি পারছেন।
নূর মোহাম্মদ ওরফে নূরু নামের এক ধান-চালের ব্যবসায়ী বাজি ধরলেন। তিনিও ঘোষণা দিলেন, এভাবে সাঁতার কাটতে পারলে তাঁর সব ধান বিক্রি করে তিনি টাকা দিতে রাজি। তাঁর ঘরে ৭ মণ ধান ছিল। কিন্তু একজন প্রান্তিক ব্যবসায়ীকে সর্বস্বান্ত করে, এমন বাজিতে মোসাদ্দেক হোসেন গেলেন না।
বাজিতে জিতেও লাভ হলো না
এবার এগিয়ে এলেন সেই যুবক, যাঁর কারণে এত হুজ্জত। তিনি ভেবেছিলেন, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কেউ আবার সাঁতার কাটে কী করে। মাঝখান থেকে মুফতে আরও কিছু টাকা পাওয়া যাবে। হাজার হাজার মানুষ শিবগঞ্জের বারসিয়া গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীর একটি ছোট চ্যানেলের সামনে এসে জড়ো হলো। এটার প্রস্থ ছিল প্রায় ১০০ মিটার। সবাইকে তাক লাগিয়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেই চ্যানেলটা পার হয়ে গেলেন। ওই সময় নদীতে তাঁর সাঁতার দেখেছিলেন একই গ্রামের বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম। তাঁর বয়স এখন ৫৭ বছর। তিনি একজন ব্যবসায়ী। রাজশাহী শহরে থাকেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, নদীতে হাত-পা বেঁধে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হলো। সাহায্যকারী হিসেবে তাঁর সঙ্গে যাঁরা যাচ্ছিলেন, সাঁ করে তাঁদের পেছনে ফেলে নদীটা পার হয়ে গেলেন তিনি।
একই কথা বললেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তৌহিদুল ইসলামও। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তাঁর পরিষ্কার মনে আছে, এলাকায় একটা খবর ছড়িয়ে পড়ল বারসিয়া নদীতে হাত-পা বাঁধা সাঁতার হবে। তখন হাইস্কুলে পড়েন। নদীর ধারে হাজার হাজার মানুষ। দেখা গেল দুজন সাহায্যকারীকে পেছনে ফেলে মোসাদ্দেক হোসেন নদী পার হয়ে গেলেন। কিন্তু বাজি জিতেও লাভ হলো না মোসাদ্দেক হোসেনের। কারণ, সেই যুবক বাজির টাকা পরিশোধের জন্য তাঁর শ্বশুরের কাছে দাবি করেছিলেন। মোসাদ্দেক হোসেন রাগে–ক্ষোভে সেই টাকা নেননি। নিজেই কষ্ট করে ধারের টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করেন।
মানুষ যতক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তার চেয়ে বেশি সময় তিনি বস্তাবন্দী অবস্থায় পানিতে ভেসে থাকতে পারবেন। আর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ৭ ঘণ্টায় অন্তত ১২ কিলোমিটার সাঁতার কাটতে পারবেন। আর মুক্ত অবস্থায় এখনো টানা ৫০ কিলোমিটার সাঁতার কাটতে পারবেন বলে আশা করছেন। তবে ৭০ বছর বয়সে আগের চেয়ে তাঁর গতি অর্ধেক কমে যেতে পারে।