যেদিন পৃথিবীতে নেমে এসেছিল চন্দ্র

মায়ের পেটে থাকতে ওর নাম রেখেছিলাম চন্দ্রবিন্দু। আমার বউ প্রমি সারাক্ষণ ‘চন্দ্র’ ‘চন্দ্র’ করত। অফিস থেকে ফিরে আমি যখন ‘চন্দ্র’ ডাকতাম, তখনো লাথি দিয়ে উত্তর দিত। তারপর পৌষ মাস এল, লম্বা চুলে কলমিলতার মতো বিনুনি বেঁধে ওটিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো প্রমি। অন্তঃসত্ত্বা নারী এত সুন্দরী হতে পারে, বউকে না দেখলে জানতামই না। জ্বরের শরীর, পেটে আরেকটি প্রাণ, তবু তার চেহারা দিয়ে রূপের ছটা ঝলকে পড়ছিল।

মা–বাবার সঙ্গে আরিয়া রাজেশ্বরী
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

যতই সংযত থাকার চেষ্টা করছিলাম, হৃৎপিণ্ডের শব্দ যেন বেড়েই চলছিল। মনে হচ্ছিল, এই যেন শব্দটা সবাই শুনে ফেলল! কনকনে ঠান্ডায় হাত–পা জমে যাচ্ছিল। বলতে বলতেই দূতের মতো এক নারী আমার মেয়েকে নিয়ে এলেন, ‘এই সরেন সরেন। বাবা কে? বাবা কে?’ খেলায় জিতলে, শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়কে সবাই যেভাবে কোলে তুলে আকাশে ছুড়ে মারে, পরিবার ও বন্ধুবান্ধব তেমনি আমাকে নায়কের মতো সামনে এগিয়ে দিল—‘এই যে ইনিই বাবা’।

পাখির মতো ওজন। লম্বা লম্বা হাত-পা মেলে সে আমার কোল দখল করে নিল। পিটপিট চোখ মেলে তাকিয়ে যেন বলছে, তুমিই তাহলে সেই লোক! আমার পাপা! মায়ের পেটে থাকাকালে আমি সন্তানের সঙ্গে প্রচুর কথা বলেছি। জানি না সে কণ্ঠ তার মনে আছে কি না, তবে তার নড়াচড়া দেখে আমি চোখ বুজে বলে দিতে পারতাম। কারণ, প্রমির গর্ভে সে যখন হাত–পা ছুড়ত, একই গতিতে একই মহাকর্ষ ত্বরণে সে তখনো লাথি দিচ্ছিল। প্রমির বেবিবাম্পে আমি কান রাখতাম, হাত রাখতাম। পেটের চামড়ার ওপাশে যার বসবাস ছিল, সে আমার বহুদিনের চেনা, সে পলকা শরীর আমার মুখস্থ ছিল।

সিলেটের বিখ্যাত গাইনোকোলজিস্ট ডা. দীলিপ ভৌমিক মনে হয় আমার উত্তেজনা টের পেয়েছিলেন, তাই ওটি ড্রেস পরেই দেখা করতে এলেন। বললাম, ‘স্যার আমি কি আপনার হাতটা ধরতে পারি?’ ভদ্রলোক হেসে দিলেন, ‘কনগ্র্যাচুলেশন্স ম্যান। এত খুশি হলে চলবে না, ফাদারহুড কিন্তু কঠিন বিষয়।’

আরিয়া তখন মায়ের গর্ভে

আমার মেয়েটা যেদিন জন্ম নেয়, সিলেটে সেদিন কনকনে শীত। ঘন কুয়াশায় হাতও দেখা যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পরেই তাকে কেবিনে দেওয়া হয়। আমার মা ও শাশুড়ি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হিটার দিয়ে কেবিন গরম করা হলো। আমার মেয়ের প্রাথমিক পরিচর্যার দায়িত্ব নিল বোন সুনন্দা। মা অচেতন, বাবা আনাড়ি; এমতাবস্থায় সুনন্দা হলো আমার বাচ্চার গডমাদার। সারা রাত নিরলস পরিশ্রমের পর ভোরের দিকে আমার মেয়ের চেহারায় রং ফিরল।

পরিবারের আমি বড় ছেলে, প্রমি তার পরিবারের বড় মেয়ে, আমাদের কন্যা দুই পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের প্রথম সন্তান। চারদিকে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। বাবা পরদিন সেই বন্যায় ভাসতে ভাসতে একটি বড় রাজহাঁস নিয়ে নাতনি দেখতে এলেন। ছোট ভাই–বোনেরা ভাতিজি ও ভাগনিকে নিয়ে একেকজন একেকভাবে আনন্দ–ফুর্তি করছে। শুভাকাঙ্ক্ষীরা ফোন দিচ্ছেন, হাসপাতালে এসে অনেকে দেখা করে যাচ্ছেন। দিনটি এখনো আমার কাছে তরতাজা। আমার কন্যা সামান্য খায়, বেশি ঘুমায়। নানি-দাদি যে নকশিকাঁথাগুলো বানিয়ে এনেছিল, একটু পরপর সেগুলো ভিজিয়ে দেয়। কান্না পেলে সে হাসপাতাল কাঁপিয়ে কাঁদে। ডাক্তার-নার্সরা সেগুলো নিয়ে আবার হাসাহাসি করেন। বড়দিনের আমেজে সিলেট শহরেও আনন্দের জোনাকি ঝিকিমিকি হয়ে জ্বলছিল যেন।

মা প্রমির সঙ্গে আরিয়া রাজেশ্বরী

চন্দ্র নামটি শেষ পর্যন্ত আর টেকেনি। দুদিনের মাথায় তার একটি গালভরা নাম রেখেছি ‘আরিয়া রাজেশ্বরী’। প্রত্যেক মা–বাবা চান তাঁর সন্তান সাফল্যের উঁচু শিখরে সিংহাসন পেতে বসুক। যদিও সাফল্যের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম। ‘গেম অব থ্রোনস’ দেখে সেখানকার একটা চরিত্র থেকে আরিয়া নামটা পছন্দ করি। সিরিজে আরিয়া বিশ্বভ্রমণ করে। অন্যতম আদিমানুষ আর্যরা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে ভারতীয় উপমহাদেশে এসে বসতি স্থাপন করে। পার্সিয়ান ভাষায় আর্য হচ্ছে আরিয়া। সবকিছু মিলিয়ে মেয়ে জন্মের পরপরই আমরা চেয়েছি সে একজন পর্যটক হোক, দেশ–বিদেশ ঘুরে বেড়াক। বড় হয়ে মনের মতো সে যদি ভ্রমণ করতে পারে, আমার কাছে সেটাই হবে তার সাফল্য। অবশ্য ঘোরাঘুরি তার পছন্দ না–ও হতে পারে, এতেও আমার আপত্তি নেই। প্রচণ্ড স্বাধীনতা দিয়ে তাকে আমি বড় করতে চাই। বেশির ভাগ সময়ে আরিয়াকে কোলে নিয়ে আমি হাঁটি আর এসব ভাবি। আমার মেয়েটা যেন নিজের রাজ্যের রাজেশ্বরী হয়।

আজ ২০ ডিসেম্বর, আরিয়া রাজেশ্বরীর এক বছর পূর্ণ হলো। মা–বাবা হিসেবে আমরা নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যার সবটাই দুজনে মিলে উপভোগ করছি।

লেখক: উপপরিচালক, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়