প্রথম আলো ট্রাস্টের ত্রাণ নিয়ে বন্ধুসভার বন্ধুদের সঙ্গে নোয়াখালীর সেনবাগের দুর্গত এলাকায় গিয়েছিলেন সজীব মিয়া। ঢাকায় ফিরে লিখেছেন সেই অভিজ্ঞতা
সোনাইমুড়ী বাইপাস মোড় থেকে সেনবাগ উপজেলা সদরে যাওয়ার রাস্তায় এখনো হাঁটুপানি। কোথাও কোথাও রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে মৃদু স্রোত বয়ে যাচ্ছে। মিনি ট্রাক, পিকআপ, ট্রাক্টরচালিত ট্রলিই হয়ে উঠেছে এলাকার যাত্রীবাহী বাহন। অতীব জরুরি প্রয়োজনে এসব বাহনে করেই মানুষ যাতায়াত করছেন। পথের দুই পাশে ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা মানুষ ত্রাণবাহী যান দেখলেই এগিয়ে আসছিলেন। ২৮ আগস্ট জলমগ্ন এই পথেই শম্বুকগতিতে চলার পর আমাদের বহনকারী ট্রাক থামে লুধুয়া গ্রামের মাথায়। ১০ কিলোমিটারের মতো পথ, অথচ মনে হচ্ছিল দীর্ঘ এক যাত্রা শেষে পৌঁছালাম।
প্রথম আলো ট্রাস্টের ত্রাণ নিয়ে এসেছি। সঙ্গে আছেন নোয়াখালী বন্ধুসভার সদস্যরা। সোনাইমুড়ী-সেনবাগ মূল রাস্তা থেকে লুধুয়ায় ঢোকার মুখেই একটা কালভার্ট। তার পাশে দু-তিনটি দোকানঘর নিয়ে জনা পঞ্চাশেক মানুষ দাঁড়ানোর মতো উঁচু জায়গা। বন্যার মধ্যেও এটুকু জায়গা টিকে আছে। সেখানে গিয়েই দাঁড়াই। এর মধ্যেই বন্ধুসভার বন্ধুদের সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন গ্রামের এক দল তরুণ। দারুণ তৎপর এই স্বেচ্ছাসেবীরা। লুধুয়া গ্রামের বাসিন্দা এক সেনাসদস্য ছুটিতে বাড়ি এসে ত্রাণ সরবরাহ ও উদ্ধারকাজে নেমে পড়েছেন। লুধুয়ায় আসার আগে তাঁর সঙ্গেই আমাদের প্রাথমিক যোগাযোগ হয়েছিল। গ্রামের তরুণেরা তাঁর নির্দেশ মেনে ট্রাক্টরচালিত ট্রলিতে তুলে নেন ত্রাণের খাদ্যপণ্য ভরা ব্যাগ আর পানির বোতল।
কালভার্টের পাশেই আনা ছিল ফাইবারের তৈরি ডিঙিনৌকা। মাছের ঘের বন্যায় প্লাবিত হওয়ার পর এই ফাইবারের নৌকাগুলো ত্রাণ ও মানুষকে উদ্ধারে কাজে লাগানো হচ্ছে। ট্রলি থেকে কিছু ত্রাণসামগ্রী এসব নৌকায় তুলে নিয়ে দূরের এক পাড়ায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে চলে যান বন্ধুসভার কয়েকজন সদস্য। কয়েকজন গ্রামবাসীসহ আমরা বাকিরা ট্রলিতে বসেই ডুবে থাকা সড়ক ধরে এগোতে থাকি লুধুয়া গ্রামের ভেতরে।
ত্রাণের বস্তার ওপর কোনোরকমে কায়দা করে বসেছি আমরা কয়েকজন। সরু রাস্তায় নিজেকে সামলানোর সঙ্গে ওপরে নুইয়ে পড়া বাঁশের কঞ্চি, আম-কাঁঠালগাছের ডালও সামলাতে হচ্ছিল। গ্রামবাসীদের মধ্যে মাঈনুদ্দীন নামের একজন ট্রলিতে আমার পাশেই দাঁড়িয়েছেন। তিনি ট্রলিতে উঠেছেন ত্রাণের আশায়। যদিও মুখ ফুটে সে কথা বলছেন না। তবে গল্পের ঢঙে বলছিলেন চোখের সামনে লুধুয়া গ্রাম ডোবার কথাগুলো—কয়েক দিন টানা বৃষ্টি। গুমোট গরমে স্বস্তির বৃষ্টি ভেবে শুরুতে লুধুয়া গ্রামের মানুষ উপভোগই করছিল। রাস্তার দুই পাশে পানি জমলে মাছ ধরার উৎসবের মতো আয়োজনও হয়েছিল। সেই উৎসব যে কয়েক দিনে এমন ভোগান্তিতে রূপ নেবে, কে ভেবেছিল। এক সকালে উঠে দেখা গেল কারও ঘরে পানি, কারও দরজায়। আঙিনায় নামলে কাপড় বাঁচানো দায়। কোনোরকমে বাড়ি থেকে বের হয়ে অনেকে পথ ধরলেন আড়াই কিলোমিটার দূরের কানকিরহাটের। সেখানকার স্কুল-কলেজের তিনতলা ভবনে কোনো রুমে যদি ঠাঁই হয়।
মাঈনুদ্দীন পেশায় অটোরিকশাচালক। রাস্তায় পানি উঠতে দেখে নিজের অটোরিকশা উঁচু এক বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। অন্যদের মতো তিনিও এখন পানিবন্দী। কিন্তু ঘর ছাড়তে হয়নি। খাটের নিচে ইটের ওপর ইট দিয়ে কোনোরকমে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন। লাকড়ির চুলার ব্যবস্থা করেছেন। শুরুতে কয়েক দিন ঘরের জমানো খাবার খেয়েছেন। দিন কয়েক পর সেসব ফুরিয়ে গেছে। এখন ত্রাণের পথ চেয়ে থাকেন।
লুধুয়া গ্রামের সড়ক ঊরুসমান পানিতে ডুবে আছে। ট্রাক্টরচালক এই গ্রামের মানুষ বলেই অনুমান করে এগিয়ে যাচ্ছেন উঁচুমতো একটা জায়গায়। সেখানে গিয়ে আরও কয়েকটি পাড়ায় দুর্গতদের জন্য ভাগ করে দেওয়া হবে ত্রাণ। মাঈনুদ্দীন নোয়াখালীর আঞ্চলিক টানে বলেন, ১০-১২ দিন অটোরিকশা নিয়ে বের হতে পারেননি তিনি। তাই আয়ও নেই। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের জন্য এটা যে কী রকম কষ্টের, তা কাকে বোঝাবেন তিনি।
মিনিট পনেরো গ্রামের পথে যেতে যেতে দেখি মাঈনুদ্দীনের কথাই ঠিক। প্রতিটি বাড়িতে বন্যার পানি। কোনো কোনো বাড়িতে গলাসমান পানি। দেখে মনে হয় কোনো বিধ্বস্ত গ্রামে এসে ঢুকে পড়েছি। পথে পড়ল লুধুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলের দুটি ভবনে কোমরপানি। আরকটি ভবনের ছাদে আশ্রয় নিয়েছে গ্রামের কিছু পরিবার। তারই এক কোনায় এক ডেকে রান্না হচ্ছিল সবার জন্য দুপুরের খাবার। আমরা লুধুয়া পশ্চিমপাড়ার মসজিদের সামনে থামি। মসজিদের ভেতরের পানি নেমে গেছে। তবে আশপাশে হাঁটুপানি। মসজিদের এক কোণে কিছু ত্রাণ নিয়ে গিয়ে রাখা হয়। ট্রলি থেকে নেমে স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে ত্রাণ টানার কাজে লেগে পড়েন মাঈনুদ্দীন। ট্রলি থেকে নামানো ত্রাণ বণ্টনের জন্য যখন নৌকায় তোলা হচ্ছিল, তখনই মাঈনুদ্দীন এগিয়ে আসেন ট্রাক্টরের কাছে। মাথা নিচু করে বলেন, তাঁরও ত্রাণের একটি প্যাকেট দরকার।
ত্রাণ হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় নিদারুণ এক অনিশ্চয়তার কথা বলেন মাঈনুদ্দীন, ‘এই পানি কত দিন থাকবে কে জানে। যদি এক মাসেও পানি না নামে, রিকশা চালাতে পারব না। তখন কী খাব?’
জলমগ্ন লুধুয়ার ত্রাণ বিতরণ করতে করতে বিকেল হয়ে গেল। বন্ধুসভার কিছু সদস্য যাঁর যাঁর দায়িত্ব শেষে ছোট নৌকায় ফেরার পথ ধরেছেন। আমরা কয়েকজন ট্রলিতেই মূল সড়কের দিকে যেতে থাকি। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকেরাও সঙ্গে। ত্রাণ দিতে গিয়ে প্রত্যেকে ভিজে জবুথবু। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এভাবেই নাকি তাঁদের দিন যাচ্ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মানুষের বাড়ি বাড়ি ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন। কারও কোনো বিপদের কথা কানে এলেই ছুটে যাচ্ছেন সেই বাড়িতে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে থাকা মানুষদের তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থাও করছেন বড়দের সঙ্গে মিলে।
লুধুয়ার এই স্বেচ্ছাসেবী দলের অন্যতম সদস্য হলেন রাতুল হাসান, কাজী মাজহারুল ইসলাম, মোহাম্মদ উমায়ের, শাকিল হোসাইন, আবদুল্লাহ আল ফয়সাল ও মোহাম্মদ সোহাগ। ছয়জনই বন্ধু। তাঁদের কেউ গত বছর এইচএসসি পাস করে স্নাতক পড়ছেন, কেউ আবার বিদেশে কাজের সন্ধানে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
যেদিন আকস্মিকভাবে গ্রাম প্লাবিত হলো, সেদিন থেকেই তাঁরা মাঠে আছেন। শুরুতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বয়স্ক মানুষ, নারী ও শিশুদের উদ্ধার করে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন আড়াই কিলোমিটার দূরের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে। এরপর গ্রামের স্কুল ও নির্মাণাধীন মাদ্রাসা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে চালু করেছেন। এই আশ্রয়কেন্দ্রেও অনেককে বাড়ি থেকে এনে তুলে দিয়েছেন। প্রতিদিনই ফেসবুকে গ্রামের পরিস্থিতির আপডেট জানান রাতুল। তাঁর পোস্ট দেখে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ-আমেরিকায় থাকা গ্রামের প্রবাসীরা পাশে দাঁড়িয়েছেন। নিয়মিত সহায়তাও দিচ্ছেন কেউ কেউ। নিজেদের এলাকার মানুষের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে কীভাবে গ্রামে ত্রাণ আনা যায়, সেই চেষ্টাও করেন তাঁরা।
অন্যদের জন্য উজাড় করে দেওয়া এই স্বেচ্ছাসেবীদেরও সবার বাড়িতে পানি। নিজেদের পরিবার দুর্ভোগে থাকলেও কাজ করে যাচ্ছেন অন্যদের সহায়তায়। রাতুল হাসান বলছিলেন, ‘গ্রামের মানুষের এই দুরবস্থার সময় যদি পাশে দাঁড়াতে না পারি, তাহলে কবে দাঁড়াব।’