দেশি আবহে আধুনিক এক রেস্তোরাঁ

আড়ংয়ের সঙ্গে যৌথভাবে তেজগাঁওয়ে নতুন একটা রেস্তোরাঁ চালু করেছে এমারেল্ড গ্রুপ। টেরাকোটা টেইলস ও বেকারি ডো ডাইরিজ নামে অন্য রকমের এ রেস্তোরাঁর নকশা করেছেন হাইভ আর্কিটেক্টের স্থপতি রাফিয়া মারিয়াম আহমেদ

ভবনটি আসলে আড়ংয়ের গুদামঘর ছিল। অনেক পুরোনো। ভবনের শেওলাপড়া দেয়ালগুলো দেখেই চট করে মাথায় এল, যা করব মূল কাঠামো ঠিক রেখেই করব। এরপর মাথায় এল, যেহেতু বাংলা খাবারের পদ থাকবে, তাই গ্রামের মাটির ঘরের আদলে সাজাই। মাটি দিয়েই তো আমাদের প্রাচীন বাড়িঘরের নকশা করা হতো। বিভিন্ন সভ্যতার যে নিদর্শন এ দেশে আছে, সেখানেও চোখে পড়ে টেরাকোটার নানা নকশা। এই প্রাথমিক ভাবনা থেকেই নকশার কাজ শুরু করি। আমার মনে হয়েছে, মাটি বা টেরাকোটার মতো বিষয়গুলো আমাদের শিকড়ের কাছাকাছি নিয়ে যায়। শুধু খাবার নয়, গ্রামবাংলার আবহ আনতে আর কী কী করা যায়, সেটা নিয়েও ভাবতে থাকি।

রেস্তোরাঁর বাইরে এই কৃত্রিম জলাশয়ে ফুটে আছে নীল শাপলা

পুরো ঘর গোলাকার হওয়ায় সুবিধা হয়েছিল। মাটির ঘরের মেঝে যেমন থাকে, রেস্তোরাঁর মেঝেতে সেই রকম ভাব রাখতে চেয়েছি। যে কারণে ঝাঁ–চকচকে টাইলসের ব্যবহার করার বদলে মেঝেগুলো পাকা করে মাটির প্রলেপ দিয়ে খানিকটা প্রাকৃতিকভাব রেখে দেওয়া হয়েছে। দেয়ালগুলো দেখলেও মনে হবে মাটির প্রলেপ দেওয়া। বাইরের দেয়ালের স্যাঁতসেঁতে ভাবটা শুধু আমরা কমিয়ে এনেছি।

প্রবেশ পথে টালির ছাউনি

রেস্তোরাঁয় প্রবেশপথ বেশ খানিকটা লম্বা। সে জায়গায় আমরা চালা ব্যবহার করেছি। আর চালার ছাউনি হিসেবে টালির বিকল্প অন্য কিছু ভাবতে চাইনি। এই ছাউনির ডান দিকে লম্বা একটা বাঁশঝাড় রাখা হয়েছে। আর বাঁ দিকে রেস্তোরাঁর গা ঘেঁষে ছোট্ট একটা পুকুর, যেখানে ফুটে আছে শাপলা, পানিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা ধরনের মাছ। গ্রামের পুকুরের একটা আবহ রাখার চেষ্টা আরকি। এই পুকুরের পাশে রয়েছে নানা রকম ফুলগাছ, ভেতর থেকে জানালার পাশে বসে দেখলে খানিকটা গ্রামের বাড়ির কথাই মনে করিয়ে দেবে।

ভেতর থেকে বাইরের পরিবেশ

রেস্তোরাঁর চারদিকেই খোলামেলা জায়গা। একদিকে বকুল আর কাঠগোলাপের গাছ, ফাঁকে ফাঁকে চেয়ার–টেবিল পাতা, মাথার ওপর ছাতা। কাজ শুরু করার পরপরই ফুলগাছগুলো লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল, রেস্তোরাঁ তৈরি হতে হতে যাতে বেড়ে ওঠে। অতিথি যখন বাইরে খেতে বসবেন, টেবিলের ওপর টুপ করে যদি একটা কাঠগোলাপ ঝরে পড়ে, ব্যাপারটা নিশ্চয়ই খারাপ লাগবে না। এখন সেটা পড়ছেও। রেস্তোরাঁর পেছনের দিকের খোলা অংশে নানা রকম ভেষজ আর শাকপাতার আবাদ করা হচ্ছে। এসব শাকপাতা রেস্তোরাঁর রান্নার কাজেই ব্যবহার করা হবে। প্রকৃতিতে স্ট্রেইটলাইন খুব কম, আমিও এখানে স্ট্রেইটলাইন রাখিনি।

এবার চলুন টেরাকোটা টেইলসের মূল রেস্তোরাঁ, অর্থাৎ অন্দরটা ঘুরে আসি।

দেয়ালের কুলুঙ্গিতে বসানো টেপা পুতুল

মাটির ঘরে জিনিসপত্র রাখার জন্য আগের যুগে দেয়ালে যেমন কুলুঙ্গি রাখা হতো, সে রকম করে ভেতরের দেয়ালে খোপ খোপ রেখেছি। আর সেখানে বসিয়ে দিয়েছি টেপাপুতুল। সাধারণ টেপাপুতুলের চেয়ে আমাদেরগুলো আকারে একটু বড়। নকশার জন্য আমার যেটুকু লম্বা পুতুল দরকার ছিল, সেভাবেই গড়ে দিয়েছেন চারুকলার স্বপনদা।

জানালা–দরজার কোনাগুলোও হালকা বাঁকানো, যাতে মাটির ঘরের নরম ভাবটা আরও প্রতিষ্ঠা পায়। জানালায় ব্যবহার করা হয়েছে খড়খড়ি, যা একদিকে দেবে প্রাইভেসি, আবার রোদ–বৃষ্টি বাঁচিয়ে বাতাস চলাচলের সুযোগও রাখবে। গ্রামের বাড়ির ঐতিহ্য মাথায় রেখে চেয়ার–টেবিলে বেত আর কাঠকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বেতের ল্যাম্পশেডগুলো বদলে দিয়েছে ভেতরের আবহ। দেয়ালের একটা অংশে কিছু প্লেট ব্যবহার করেছি। গুলশানের বিভিন্ন অ্যান্টিক শপ ঘুরে ঘুরে এগুলো সংগ্রহ করেছি।

বাঁশ বেতের জিনিসপত্র

রেস্তোরাঁর মাঝখানে বিশাল একটা থাম, এটা নিয়ে শুরুতে ভাবনা ছিল। কিন্তু ওপর দিকে ল্যাম্পশেড আর থামের চারদিক ঘিরে বসার ব্যবস্থা করায় কলাম খুব একটা চোখে পড়ে না। ভেতর থেকে ছাদে যাওয়ার জন্য একটি বাঁকানো সিঁড়ি উঠে গেছে। এই সিঁড়ি তৈরিটাও ছিল দারুণ চ্যালেঞ্জের। কারণ, হঠাৎ একটা সিঁড়ি করলে সেটা কোন উপাদানে করতে হবে, তা নিয়ে যেমন ভাবতে হয়, তেমনি এটার সৌন্দর্য ঠিক রাখার ব্যাপারও আছে। তাই সিঁড়ির পাশ দিয়ে টেরাকোটার নকশা আর আলো–ছায়ার মায়া খুব যত্ন নিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

হাইভ আর্কিটেক্টের স্থপতি রাফিয়া মারিয়াম আহমেদ

ছাদে উঠে আসার পর রেস্তোরাঁর আবহে আবার খানিকটা বদল চোখে পড়বে। এই গোলাকার ছাদের কোনাজুড়ে টালি দিয়ে আধা ছাউনিমতো একটা জায়গা করা হয়েছে, চেয়ার–টেবিল ফেলে খোলামেলা পরিবেশে বসার ব্যবস্থা। ছাদের মাঝখানের জায়গাটুকু রাখা হয়েছে খোলা আকাশ দেখার জন্য। হঠাৎ বৃষ্টিতে এ জায়গায় বসে চা খেতে খেতে সময় পার করে দেওয়া যাবে। ছাদের একদিকে ২০ জনের বসার সুবিধাসহ একটা ছোট্ট রুম। কেউ চাইলে রুমটা বুক করে মিটিং করতে বা নিজস্ব পার্টি দিতে পারবে।

ছাদে এভাবে বসানো হয়েছে টেবিল চেয়ার

প্রজেক্টটা আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। কাঠ, বেত, মাটির মতো উপকরণ দিয়ে কাজ করার এ প্রচেষ্টা শহুরে মানুষ ঠিক কীভাবে নেবে, বুঝতে পারছিলাম না। এক বছরের মতো সময় পেয়েছিলাম। তবে মহামারির কারণে আমার ডিটেইলিং করতে সুবিধা হয়েছিল। ছাদের উচ্চতা পুরোপুরি ঠিক মনে হয়েছে আমার কাছে, তাই ফলস সিলিং দিয়ে সৌন্দর্যটা নষ্ট করতে চাইনি। আগেকার জিনিসগুলোই বিমূর্ত আর আধুনিক রীতিতে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি।

রেস্তোরাঁর একটি দেয়ালে এভাবে নকশা করা হয়েছে অ্যান্টিক থালা–বাটির সাহায্যে

উদ্বোধনের দিন বেশ ভয়ে ভয়ে ছিলাম। অতিথিরা দেখে ঠিক কীভাবে নেবে, বুঝতে পারছিলাম না। দিনটি আমার কাছে ছিল অনেকটা পরীক্ষার মতো। তবে সবাই যখন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে, কী যে আনন্দ হচ্ছিল, বলে বোঝাতে পারব না। একজন স্থপতির কাছে তাঁর প্রতিটি কাজই সন্তানসম। অন্যদের সেটা দেখে আনন্দ হলেই নিজের কাজ সার্থক মনে হয়।