শিশুর জেদ ও রাগ বা অনেক আচরণ দেখে মা–বাবা হতবিহ্বল হয়ে যান। শাসন না করেও তাকে সঠিক আচরণের শিক্ষা কীভাবে দেবেন, এ নিয়ে দ্বিধায় থাকেন।
শিশুকে শাসন করার প্রক্রিয়া কী হতে পারে, সে সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লাইলুন নাহার জানান, শাসন করা শব্দটি নির্ভর করছে কোন ঘটনা বা পরিপ্রেক্ষিতে তা ব্যবহার করা হচ্ছে, তার ওপর। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে শাস্তি দিলে শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করার প্রবণতা বেড়ে যায়। তার চেয়ে তাকে বোঝাতে হবে কোন কাজটি ভালো আর কোনটি মন্দ। নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে ভালো-মন্দের পার্থক্য শিশুর মনস্তত্ত্বে ঢুকিয়ে দিতে পারলে সে নিজেই বুঝতে পারবে কোনটি অন্যায়। তাহলে অন্যায় করা বা মিথ্যা বলার মতো কাজ থেকে সে নিজেকে দূরে রাখবে।
একটা বয়সে শিশু অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করে, সেটা যে ঠিক হচ্ছে না, এটা তাকে বোঝানোর জন্য শারীরিকভাবে শাস্তি দিয়ে বা শাসন না করে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারি। এ ক্ষেত্রে টাইম আউট বা টাইম ইন্টারভ্যাল প্রসেস ভালো কাজে দেয়।
ধরুন, সে কোনো অন্যায় করল। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে তার পছন্দের কাজ থেকে কিছুক্ষণ বিরত রাখা যেতে পারে। সে হয়তো নির্দিষ্ট কোনো কার্টুন দেখতে বা গেম খেলতে পছন্দ করে। তাকে বলা যে অমুক কাজের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আজ সে নিজের পছন্দের কাজটি করা থেকে বিরত থাকবে। তাহলে সে নিজেই বুঝতে পারবে যে অন্যায় কাজ করেছিল।
আবার স্কুলে কোনো অন্যায় করলে তার বাড়ির কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে বা স্কুল ছুটির পর বেশি সময় পর্যন্ত অন্য কোনো কাজে তাকে ব্যস্ত রাখা যেতে পারে। এতে সরাসরি শারীরিক শাস্তি দেওয়া হলো না, আবার বাড়তি কাজের মাধ্যমে নিজের ভুলটাও সে বুঝতে পারল।
শিশু তার পরিবারের কাছ থেকেই আচরণ শেখে উল্লেখ করে লাইলুন নাহার বলেন, তাকে আচরণ শেখাতে তাই কিছু প্যারেন্টিং টেকনিক অনুসরণ করা যেতে পারে। তার কাছ থেকেই জানা গেল, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ডায়না বামরিন্ডের মতে, সন্তান পালনের সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো অথরিটেটিভ প্যারেন্টিং। এই পদ্ধতিতে শিশুকে অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং তার মতামতের মূল্যায়ন করা হয়। যেটি তার নৈতিকতা বিকাশে সাহায্য করে। এতে শিশুর ইতিবাচক কাজকে পুরস্কৃত করা হয়।
অভিভাবকের আচরণের কারণে সে যৌক্তিক চিন্তা করতে শেখে। অন্যায় কাজের পর যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, সেটাও শিশুকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। কোনো একটি অন্যায় করার পর তার শাস্তির মধ্যে যদি সামঞ্জস্য না থাকে, তাহলে শিশুর মধ্যে নেতিবাচক চিন্তার সৃষ্টি হয়। তাই তাকে কেন কী কারণে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে বা পছন্দের কাজ থেকে দূরে রাখা হচ্ছে, সেটি শিশুকে বুঝিয়ে বলতে হবে।
এতে তার মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে। পরে যেটা তার নৈতিক ভিত্তি শক্ত করতে ও বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বশীল আচরণ করতে সহায়তা করবে।
শিশুকে শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই কীভাবে বড় করতে হবে তার একটি গাইডলাইন দিয়েছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ।
সেখানে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির চাইল্ড অ্যান্ড ফ্যামিলি সোশ্যালওয়ার্ক বিভাগের অধ্যাপক লুসি ক্লুভার বলেছেন, অভিভাবকেরা শিশুর সঙ্গে চিৎকার করেন বা মারধর করেন। কারণ, তাঁরা কোনো কারণে চাপে থাকেন এবং শিশুকে শাসনের অন্য কোনো পথ দেখতে পান না।
কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বকাবকি করে বা মেরে শিশুর কাছ থেকে কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়; বরং এটি শিশুর জীবনে ভীষণ প্রভাব ফেলে।
তার চেয়ে শিশুর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে জোর দিলেন অধ্যাপক লুসি। তিনি বলেন, দিনে ৫ থেকে ২০ মিনিট সময় বাবা বা মাকে শিশুর জন্য বরাদ্দ করতে হবে। এ সময় তিনি শিশুর সঙ্গে নিবিড়ভাবে সময় কাটাবেন, দুজনে মিলে টুকটাক কিছু কাজ ও কথা বলবেন।
অনেক সময় শিশুরা মা–বাবার মনোযোগ পাওয়ার জন্যও এমন কাজ করে বা আচরণ করে, যা প্রচলিত অর্থে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই যখন সে অন্যায় করবে, তখন চিৎকার না করে যখন সে ভালো কিছু করবে, সেটার মন খুলে প্রশংসা করতে হবে। এমনকি সে যদি বন্ধু বা ভাইবোনের সঙ্গে খেলনা ভাগাভাগি করে নেয়, সেটারও প্রশংসা করতে হবে।
এতে শিশু ভালো ব্যবহার করতে উৎসাহী হবে এবং নিয়মানুবর্তিতা শিখবে।
শিশুর কাছে অভিভাবক কেমন আচরণ প্রত্যাশা করেন, তা স্পষ্ট করে বলতে হবে। কী করা যাবে না সেটা বারবার বলার চেয়ে কী করতে হবে বা কোনটা করা ভালো, সেটা বলা অনেক বেশি কার্যকর।
‘তুমি এটা কোরো না’ বা ‘ঘর নোংরা কোরো না’ বলার চেয়ে ‘তোমার খেলনাগুলো ঝুড়িতে গুছিয়ে রাখো’ বললে শিশুর জন্য বুঝতে সুবিধা হয়। সে নিয়মানুবর্তিতা শিখতে পারে, বলছিলেন অধ্যাপক ক্লুভার।
ইতিবাচক প্যারেন্টিংয়ের ওপরও জোর দিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, শিশুকে কখনোই এটা বলা উচিত নয় যে তুমি পারবে না। তাহলে সে কাজটি শুরুর আগেই ধরে নেবে এটা তার পক্ষে সম্ভব নয়।