‘ভালোভাবে বসো, আমি অচ্ছুত না’, প্রথম কথাটি সে বলেছিল

আমাদের আহ্বানে ভালোবাসার টক–ঝাল–মিষ্টি গল্প লিখে পাঠিয়েছেন পাঠক। ‘ছুটির দিনে’তে পর পর দুই সংখ্যায় ছাপা হওয়ার পর নির্বাচিত আরও একটি লেখা প্রকাশিত হলো এখানে

দুজনে আরও কাছাকাছি এনে দিলো তার একটি কথা

যার সামান্য অনুপস্থিতিতে বুকের ভেতরটা ক্ষণে ক্ষণে মোচড় দেয়, একটা শিরশিরে অনির্বচনীয় বিষাদময় অনুভূতি নেমে যায় পেট পর্যন্ত, যার সঙ্গ প্রতিটি মুহূর্তকে আনন্দময় ও রঙিন করে, এক সন্ধ্যায় তার সঙ্গে প্রথম ঘুরতে বের হয়েছিলাম। শীত তখন বিদায় নেব নেব করছে। ফোনকলে সে তার বাসার সামনে দাঁড়াতে বলেছিল। অফিস শেষ করে তৃষিত হৃদয়ের সবটুকু আকুলতা নিয়ে দুরুদুরু বুকে আমি তার বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। অপেক্ষার প্রহর মোটেই দীর্ঘ ছিল না। সময় যেন উড়ে যাচ্ছিল।

একটা ঘোরাচ্ছন্ন অনুভূতির ভেতর দিয়ে আমি দেখতে পেলাম, সে বের হচ্ছে গেট দিয়ে। টের পেলাম, আমার হৃদয়ের আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আমার শরীর হঠাৎ যেন হালকা হয়ে গেল। মাথার ভেতরটা একেবারেই ফাঁকা। তার পরনে ছিল সালোয়ার-কামিজ। সারা শরীর থেকে শুভ্র এক আভা যেন ঠিকরে বেরোচ্ছিল। চেহারায় শিশুতোষ পবিত্রতা ও সারল্যের ছাপ। তাৎক্ষণিক কোনো কথা সে বলেনি। কেবল ঠোঁটটিপে হাসছিল। হাসির সে ভঙ্গি তার একান্তই নিজস্ব। তার সিগনেচার। এ হাসিতে তার সৌন্দর্য আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। আমার মুখ দিয়েও কোনো কথা সরছিল না। কেবল তার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অপলক। এমন অভূতপূর্ব অনুভূতি ও হিরণ্ময় নীরবতার মধ্যেই আবিষ্কার করলাম আমরা রিকশায় পাশাপাশি বসে আছি। আমার আবহমান জিনের মধ্যে সঞ্চারিত হাজার বছরের সংস্কারবশত আমি কিছুটা জড়সড়। গুটিয়ে বসে আছি রিকশার এক পাশ ঘেঁষে। তবে সে ছিল বেশ সাবলীল। ‘ভালোভাবে বসো, আমি অচ্ছুত না’, প্রথম কথাটি সে বলেছিল। জগতের সব সুরের ঐকতান যেন বেজে উঠল আমার কানে। সব দ্বিধা ঝেড়ে আমি একেবারে তার পাশ ঘেঁষে বসলাম। সে আবারও হেসেছিল। ঠোঁটটিপে। সে হাসিতে আমার বুকের উদ্যানে শুকিয়ে যাওয়া তরুরাজিতে সবুজ পাতা গজাচ্ছিল। কোষে কোষে সঞ্চারিত হচ্ছিল নতুন জীবন। স্নিগ্ধ আলোয় উদ্ভাসিত আমার সম্পূর্ণ সত্তা। প্রকৃতিতে তখন বসন্ত আসি আসি করছে। কিন্তু বেশ বুঝতে পারলাম, আমার জীবনে বসন্ত এরই মধ্যে চলে এসেছে। বেইলি রোডের এক রেস্তোরাঁয় আমরা বসেছিলাম। ঘুচে যাচ্ছিল আমাদের মধ্যকার সব ব্যবধান। শরীর দুটি। কিন্তু সত্তা এক ও অভিন্ন। ফেরার পথে আচমকা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল দুজনকে। যেন মহাজাগতিক আশীর্বাদ। অলক্ষ্যে বসে যে মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের জোড়া মিলিয়ে দিলেন, সর্বাত্মঃকরণে আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলাম।

তার সঙ্গে প্রথম যেদিন বের হয়েছিলাম, সেদিন কোনো ফুল নিয়ে যাইনি। তাকে প্রথম ফুল দিয়েছিলাম পয়লা বৈশাখের দিন। সেদিন সে শাড়ি পরেছিল। সেজেছিল বেশ। খোঁপা বেঁধেছিল। আমি সেখানে ফুল গুঁজে দিয়েছিলাম। ‘জানো, এর আগে কোনো বৈশাখে আমি সাজিনি। এভাবে আয়োজন করে ঘুরতে বের হইনি। এই দিনটি আমি সব সময় মনে রাখব।’ একরাশ মুগ্ধতা ও আবেগ নিয়ে সে আমাকে জানিয়েছিল। আগ্রহ নিয়ে নববর্ষ উদ্‌যাপন করা আমারও সেবার প্রথম ছিল। আমরা ঘুরলাম, সারা দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল, মল চত্বরসহ বিভিন্ন জায়গায়। ছবি তুললাম। তার উৎফুল্লতা দেখে আমার মনে হচ্ছিল, সে যেন রূপকথার ঘুমিয়ে থাকা রাজকন্যা। ভালোবাসার জিয়নকাঠি দিয়ে আমি তাকে জাগিয়ে তুলেছি। আমার অবস্থাও তথৈবচ। আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের প্রাণভোমরা পরস্পরের হৃদয়ের ভেতর।

সময় গড়াচ্ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভালোবাসা। প্রতিনিয়ত গাঢ় হচ্ছে তার রং। ঘটনাপ্রবাহে আমাদের সম্পর্কের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বীকৃতিও মিলেছে। সর্বদা বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও পারস্পরিকতায় প্রতিটি মুহূর্ত কাটানোর শপথ নিয়েছি দুজন। ভালোবাসা দিবসে তোমাকে শুভেচ্ছা, হে প্রিয়! এভাবেই যেন আমরা পরস্পরকে আগলে রাখি অনন্তকাল। জয়তু প্রেম! জয়তু ভালোবাসা!