তাঁরা যমজ। একই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। একই রকম মেধাবী কি না, সেটা তাঁদের গল্প পড়েই বুঝে নিন।
ক্লাস ওয়ান থেকে স্নাতকোত্তর—১৭ বছর আমরা দুই বোন (বিয়াস বিনতে কামাল ও রিয়ান বিনতে কামাল) একসঙ্গে পড়েছি। শুরুতে ভিকারুননিসা নুন স্কুল ও কলেজ, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমার নাম রিয়ান। অথচ কতবার কতজন যে আমাকে ‘অ্যাই বিয়াস, অ্যাই বিয়াস’ বলে ডেকেছে। অনেকে বুঝতই না, বিয়াস আমার বড় বোন। বড় না ছাই। দুজনের জন্মের ব্যবধান মোটে দুই মিনিট।
জন্মের দিক থেকে এগিয়ে ছিল বলেই বোধ হয় স্কুলেও ও আমার চেয়ে এগিয়ে থাকত। ফলাফলের দিক দিয়ে বিয়াসের ক্রম সব সময় ছিল এক থেকে তিনের মধ্যে। আমি থাকতাম পরের দিকে, ৭ থেকে ১০–এর মধ্যে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে আমরা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উত্তীর্ণ হই।
কলেজে পড়ার সময় আমি আর বিয়াস দুজনই বিজ্ঞান মেলায় অংশ নিয়েছিলাম। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আগে বিয়াসের জ্বর এসে গেল, ও আসতে পারল না। অথচ কী কপাল, সেবার বিয়াসই পুরস্কার পেয়ে গেল, আমি পেলাম না। যখন মঞ্চে বিয়াসকে ডাকা হলো, বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করব। বোন হিসেবে পুরস্কার নিতে আমিই গিয়েছিলাম। সবাই ধরে নিল, আমিই বিয়াস। ব্যস, আমিও ওর হয়ে ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললাম!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ভর্তি হই অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগে। বিয়াস বেছে নেয় অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। আমার জন্য ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে পড়াটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আজীবন পড়েছি বিজ্ঞানে, সেখানে অ্যাকাউন্টিং পড়াটা আমার জন্য মোটামুটি ধাক্কাই ছিল। অ্যাকাউন্টিং শব্দটির বাংলা যে হিসাববিজ্ঞান, তা-ও জেনেছি অনেক পরে!
আমাদের দুজনেরই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাধিক পুরস্কার আছে। ভালো ফলের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের হাত থেকে পদক নিয়েছি। গবেষণার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপও পেয়েছে আমার বোন। শুধু যুক্তরাজ্য থেকেই ডিউক অব এডিনবরা অ্যাওয়ার্ডসহ মোট ছয়টি পুরস্কার পেয়েছি আমরা দুজন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার গণ্ডি শেষ করে আমরা দুই বোনই শিক্ষকতা শুরু করি। আমি স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে যোগ দিই। আর বিয়াস প্রথমে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, পরে সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। করোনা মহামারির সময় আমরা দুই বোন ভিনদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলাম। দুজনই এখন যুক্তরাষ্ট্রে আছি। আমি আইডাহো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার অব অ্যাকাউন্ট্যান্সি পড়ছি। আর বিয়াস পিএইচডি করছে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া স্যান ডিয়েগোর কেমিস্ট্রি অ্যান্ড বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে।
দুজন থাকি দুই রাজ্যে। গাড়িতে করে একজন আরেকজনের কাছে যেতে চাইলে প্রায় ১৫ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে থাকলেও সারাক্ষণই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত থাকি আমরা। ঘড়ির হিসাবে ক্যালিফোর্নিয়া আইডাহোর চেয়ে এক ঘণ্টা পিছিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে একা দুই বোন এসেছি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় যেখানে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে গেলেও মেয়েদের শুনতে হয়, ‘বিয়ে করে তারপর স্বামীকে নিয়ে যেয়ো’, সেখানে আমাদের এই চ্যালেঞ্জ নেওয়া সহজ ছিল না। তবে আমাদের পরিবার বিষয়টি সহজে মেনে নিতে পেরেছে বলেই আমরাও সাহস পেয়েছি।
শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে পরিচিত কেউ ছিল না। বিয়াস ২০২২ সালে এখানে পৌঁছায়, আমি পৌঁছাই দুই মাস পর। শুরুতে আমার ‘গুগল’ ছিল বিয়াস। যেকোনো প্রয়োজনে সব জিজ্ঞাসা ওকেই করতাম। আমাদের সব কাজই আমরা ভাগাভাগি করে নিই। যেমন এই লেখাটাও লিখছি আমি, সম্পাদনা করবে বিয়াস। অতএব লেখা খারাপ হলে দোষ ওর, আর ভালো হলে কৃতিত্ব আমার।