১৯৭৮ সালের ২৫ জুলাই চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইতিহাস তৈরি করে জন্ম নেন লুইস জয় ব্রাউন। সে-ই বিশ্বের প্রথম টেস্টটিউব বেবি। আর এই ‘অসম্ভবকে’ সম্ভব করার পেছনে ছিলেন তিনজন ব্রিটিশ চিকিৎসক—রবার্ট এডওয়ার্ড, প্যাট্রিক স্টেপটো ও জন পার্ডি। তাঁরাই প্রথম সফলভাবে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু শরীরের বাইরে নিষিক্ত করে সেই ভ্রূণ আবার জরায়ুতে স্থাপন করেন। সেখান থেকেই জন্ম নেন লুইস জয় ব্রাউন।
২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে আইভিএফ বা ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতিতে। ২২ নভেম্বর নেটফ্লিক্সে এই তিন চিকিৎসককে সম্মাননা জানিয়ে ‘জয়’ নামের একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। বিশ্বের প্রথম টেস্টটিউব বেবিই এই চলচ্চিত্রের বিষয়। সেখানে দেখা দিয়েছেন ৪৬ বছর বয়সী লুইস জয় ব্রাউন।
লুইসের মা লেসলি ব্রাউন ও বাবা জন ব্রাউন। এই দম্পতি ছিলেন নিঃসন্তান। বিয়ের পর ৯ বছর ধরে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ার পর তাঁরা ওই তিন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে লেসলি জানতে পারেন, তিনি মা হতে যাচ্ছেন। ১৯৭৮ সালের জুলাইয়ে ইংল্যান্ডের ওল্ডহ্যাম জেনারেল হাসপাতালে জন্ম নেন লুইস জয় ব্রাউন। তিন চিকিৎসক মিলেই লুইসের নাম রাখেন ‘জয়’। কেননা এ ঘটনা পরে বহু নিঃসন্তান দম্পতির জীবনে আনন্দ এনে দিয়েছিল।
লেসলি ও জন একই পদ্ধতিতে আবারও ১৯৮২ সালে নাটালি ব্রাউন নামে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। নাটালি বিশ্বের ৪০তম টেস্টটিউব বেবি।
প্রথমবার ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের (আইভিএফ) মাধ্যমে গর্ভবতী হওয়ার ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। গণমাধ্যম লেসলিকে হন্যে হয়ে অনুসরণ করছিল। বাড়ির সামনে পাপারাজ্জিরা ক্যামেরা তাক করে থাকতেন। লেসলি নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। সে সময়ও এগিয়ে আসেন তিন চিকিৎসকের একজন, প্যাট্রিক স্টেপটো।
রাতের অন্ধকারে নিজে গাড়ি চালিয়ে প্যাট্রিক লেসলিকে নিয়ে তাঁর মায়ের কাছে রেখে আসেন। সন্তান জন্মের আগ পর্যন্ত বাইরের কেউ জানত না লেসলি কোথায়। লেসলির সিজারের প্রক্রিয়াটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে ক্যামেরায় ধারণ করে রাখা হয়। লুইসের জন্মের পর লেসলির মা-বাবা ও চিকিৎসকেরা সংবাদ সম্মেলন করে সবাইকে সুখবর দেন। অনেকে কার্ড, ফুল আর নানা উপহার পাঠিয়ে লুইস ও লেসলিকে অভিনন্দন জানান।
সেই তিন চিকিৎসকের সবাই মারা গেছেন। ১৯৮৫ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ত্বকের ক্যানসার ম্যালিগন্যান্ট মেলানোমায় আক্রান্ত হয়ে সবার আগে মারা যান সবার ছোট পার্ডি। এ ঘটনার তিন বছর পর ৭৪ বছর বয়সে মারা যান ডা. স্টেপটো, তিনিও মারা যান ক্যানসারে। ডা. এডওয়ার্ড মারা যান ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল, ৮৭ বছর বয়সে। ২০১০ সালে তাঁকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অসামান্য অবদান রাখার জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
লুইস পরিবেশবিষয়ক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। সেই সঙ্গে তিনি টেস্টটিউবের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের একজন দূতও বটে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে নিঃসন্তান দম্পতিদের অনুপ্রাণিত করতে এ বিষয়ে বক্তব্য দেন তিনি। ২০০৭ সালে তাঁর বাবা জন ও ২০১২ সালে মা লেসলি মারা যান। ‘লুইস ব্রাউন: মাই লাইফ অ্যাজ দ্য ওয়ার্ল্ডস ফার্স্ট টেস্ট টিউব বেবি’ শিরোনামে তিনি একটি বইও লিখেছেন। ২০০৪ সালে অয়েসলি মালিন্ডার নামে একজন সিকিউরিটি অফিসারের সঙ্গে বিয়ে হয় লুইসের। তিনি নিজেই এখন দুই সন্তানের মা। ২০০৬ ও ২০১৩ সালে স্বাভাবিকভাবেই ক্যামেরন ও এইডেন নামে দুই পুত্রের জন্ম দেন লুইস। পিপল ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লুইস বলেন, ‘আমি আমার মা–বাবা আর চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞ, আমাকে জীবন দেওয়ার জন্য। জীবন সুন্দর।’
সূত্র: পিপল