‘নাহ, চাকরিটা ছেড়েই দেব।’—নিত্যদিনই কি আপনার মাথায় এমন ভাবনা ঘুরঘুর করছে? রাতে ঘুমানোর আগে মনে মনে হয়তো নিজেই নিজের সঙ্গে ঝগড়া করছেন। একবার ভাবছেন, ‘ছেড়েই দিই।’ আরেকবার ভাবছেন, ‘দেখি আরও কটা দিন।’
কর্মস্থলকে ‘টক্সিক’ মনে হতে পারে নানা কারণে। বিভিন্ন অপ্রাপ্তি বা অসন্তুষ্টি, অতিরিক্ত চাপ বা প্রোমোশন না হওয়া, টক্সিক বস, কাঙ্ক্ষিত বেতন বৃদ্ধি না হওয়া ইত্যাদি। চাকরি ছাড়ার আগে নিজেকে করতে পারেন এই ১২টি প্রশ্ন, তাহলে হয়তো সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে।
যদি মনে হয়, কাজের কারণে আপনি মানসিক বা শারীরিক চাপে আছেন বা বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন, তাহলে হয়তো ছেড়ে দেওয়াটাই শ্রেয়—বলছেন মনোবিজ্ঞানী লি চেম্বার্স। তিনি বলেন, ‘যদি বিষয়গুলো আত্মসম্মান বা আত্মরক্ষার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করবেন না। অন্যথায় এটি আপনার স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’
সমস্যার মূল কারণ যত স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করবেন, আপনার সিদ্ধান্ত ততই সহজ হবে। আপনার ভূমিকা ও দায়িত্বের পাশাপাশি প্রকল্প, বেতন, পদোন্নতির সুযোগ, কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতি, কাজের চাপ, সহকর্মী, কোম্পানির মূল্যবোধ বা সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো গভীরভাবে বিবেচনা করুন।
প্রকৃত কারণটা বের করতে চাইলে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘অ্যানাদার ডোর’–এর প্রতিষ্ঠাতা এলিয়েনর টুয়েডেলের দেখানো পথে চলতে পারেন। তাঁর বক্তব্য, ‘আপনার কাজ-সম্পর্কিত প্রতিটি অনুভূতি ও চিন্তা ১০ দিন ধরে লিখে রাখুন। এর মাধ্যমে প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসবে।’
চাকরি ছাড়ার আগে বর্তমান চাকরি ক্ষেত্রে পৌঁছানোর পেছনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করুন। কেন আপনি এই চাকরি নিয়েছিলেন, এখন পর্যন্ত আপনার ক্যারিয়ারের পথ কেমন ছিল—এসব নিয়ে একটু ভাবুন। অতীত নিয়ে চিন্তা করলে বর্তমান পরিস্থিতিকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা সহজ হয়। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা তৈরিতেও এটি সহায়ক। মনোবিজ্ঞানী লি চেম্বার্স বলেন, ‘এটা গুরুত্বপূর্ণ যে এটি আপনার ক্যারিয়ারে প্রথম পদক্ষেপ নয়। এ কথা অনুধাবন করতে পারলে নতুন একটি পদক্ষেপ নেওয়াও অনেক কম ভয়াবহ মনে হবে।’
কর্মক্ষেত্রে আপনি শেষ কবে একটা লম্বা সময় ‘সুখী’ ছিলেন, তা ভেবে দেখতে পারেন। যদি এই ভাবনা কয়েক বছর ধরে চলতে থাকে, তাহলে চাকরি ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। চাকরি ছাড়ার ইচ্ছা হয়তো জীবনের ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার বা অগ্রগতির অনুভূতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত।
এ ছাড়া বার্নআউটের আশঙ্কা বিবেচনায় নিন। বার্নআউট হলে আপনার বসের সঙ্গে কথা বলে কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে নিতে পারেন।
বার্নআউট হলো মানসিক, শারীরিক ও আবেগজনিত ক্লান্তির একটি অবস্থা, যা দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত কাজের চাপ বা স্ট্রেসের কারণে সৃষ্টি হয়। এটি সাধারণত পেশাগত জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, তবে ব্যক্তিগত জীবনের চাপও এর কারণ হতে পারে।
টুয়েডেল বলেন, এটি হতে পারে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন। শুধু আপনার বর্তমান কাজের সমস্যা, স্বপ্নের চাকরি বা প্যাশন নিয়ে ভাবা যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, আপনি কীভাবে জীবন যাপন করতে চান। আমরা আমাদের মূল্যবোধ নিয়ে খুব কম ভাবি, অথচ এখানেই আমাদের অনেক দ্বন্দ্বের মূল কারণ নিহিত।’
তাই আপনি আসলে কী চান, সেটা সময় নিয়ে একবার ভাবুন।
চাকরি ছাড়ার আগে একবার আপনার পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলুন। এই পরামর্শ আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করতে পারে। চেম্বার্স বলেন, ‘বন্ধুবান্ধব আমাদের মধ্যে এমন কিছু দেখতে পায়, যা আমরা নিজেদের মধ্যে দেখি না। আর দেখাটা ভবিষ্যতের সম্ভাবনা খোঁজার ক্ষেত্রে খুবই দরকারি।’
আবার ঘনিষ্ঠজনের সাহায্য বা সমর্থন ছাড়া জীবন পরিবর্তন করা কঠিন, বিশেষ করে যখন আপনি আর্থিক সংকটে থাকবেন। তাই চাকরি ছাড়ার আগে অবশ্যই ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের পরামর্শ নিন।
টুয়েডেল বলেন, ‘পরিবর্তন মানেই কিছু না কিছু ছাড় দিতে হয়। আপনি কোন জিনিসগুলোকে বিদায় জানাতে যাচ্ছেন, যেমন বন্ধুত্ব, সুযোগ-সুবিধা, স্থিতিশীলতা বা পরিচিত রুটিন, তা স্পষ্টভাবে বুঝলে আপনি সত্যিই এটি ছাড়তে প্রস্তুত কি না, তা পরিষ্কার হতে পারে।’
নতুন চাকরির সুযোগগুলো যদি বর্তমান চাকরিতেই পেয়ে যান, তাহলে নতুন চাকরির দরকার কী। কাজের সময় নমনীয় করা, কর্মঘণ্টা কমানো বা বেতন বৃদ্ধির সুবিধা আপনার বসের সঙ্গে কথা বলে যদি ঠিক করতে পারেন, তাহলে তো চাকরি বদলানোর প্রয়োজন হয় না।
আপনি একটি দীর্ঘ সময় এক কর্মস্থলে যেভাবে মানিয়ে নিয়েছেন, অন্য জায়গায় তো সেভাবে না-ও মানিয়ে নিতে পারেন।
আপনার বস অনেক সময় টক্সিক হতে পারে। যেমন আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা, আপনার কাজের প্রশংসা না করা, বেতন না বাড়ানো ইত্যাদি। তখন আপনি হতাশ হয়ে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আবার এটা না করে আপনি মানবসম্পদ বিভাগের সাহায্য নিতে পারেন। অনেক সময় এতে কাজ হয়।
টক্সিক বস চিনবেন কীভাবে? সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো সুযোগই তিনি রাখেন না, সবকিছুতে নাক গলান। তাহলে বুঝবেন আপনি টক্সিক বসের খপ্পরে পড়েছেন। তাঁকে এড়িয়ে চলুন।
চাকরির ক্ষেত্রটা শতভাগ মনমতো হবে না, এটাই স্বাভাবিক। তাই আপনি যে প্রত্যাশা করছেন, সেটা বাস্তবসম্মত কি না, ভাবুন। আপনি এমন কিছু চাইবেন না, যেটা বাস্তবতাবিবর্জিত। অযৌক্তিক বেতন বাড়ানোর আবদার করবেন না। নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কি সত্যিই শেখার জন্য প্রস্তুত কি না।
যুক্তরাজ্যের ক্যারিয়ার কাউন্সেলর অ্যামান্ডা রিউবেন বলেন, ‘অনেকে বিকল্প খোঁজেন। অবশেষে তাঁরা বর্তমান চাকরিতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, তাঁরা বুঝতে পারেন, এটাও তেমন খারাপ নয়।’
যখন আপনি চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরি খুঁজবেন, তখন তিন থেকে ছয় মাসের জীবিকা নির্বাহের অর্থ জমিয়ে রাখা উচিত। ক্যারিয়ার পরিবর্তন বা স্বনির্ভর কাজ শুরু করতে চাইলে অন্তত এক বছরের জীবিকার খরচ করার জন্য সঞ্চয় রাখা জরুরি।
চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় শুধু বেতন নয়, অন্য বিষয়গুলোও ভাবতে হবে। যেমন আপনার বর্তমান চাকরিতে ভালো পেনশন-সুবিধা থাকতে পারে, যা খরচ-বিশ্লেষণের সময় বিবেচনা করা উচিত। বিশেষ করে যদি আপনি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে শুরু করতে চান, তাহলে টাকাপয়সার সংস্থান করে রাখা জরুরি।
চাকরি ছাড়ার আগে একবার ভাবুন, এটা ছাড়ার সঠিক সময় কি না। কারণ, চাকরির বাজার খুব অনিশ্চিত। নতুন চাকরি পেতে ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। আপনি যদি ভাবেন কিছু না কিছু একটা হবেই, তাহলে বলতে হবে আপনি খুব সাহসী। কারণ, এ কারণে পরিবার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
যদি আপনার বর্তমান কাজের পরিবেশ অত্যন্ত খারাপ বা সহ্যের বাইরে না হয়, তাহলে আপনি ধাপে ধাপে এগোতে পারেন। অতীতের দিকে ফিরে দেখুন, বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করুন এবং ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করুন। তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নেওয়া সহজ হবে।
সব শেষে টুয়েডেলের পরামর্শ অনুসরণ করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘সবকিছু একসঙ্গে মিলে যাবে, এমন সময় কখনোই আসবে না। একসময় আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং নিজেকে বিশ্বাস করতে হবে যে আপনি সফল হবেন।’ তিনি পরামর্শ দেন, একটি নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করে তা ডায়েরিতে লিখে রাখুন। ওই সময় পর্যন্ত আপনি ভাবুন বা চিন্তা করুন। তারপর নির্ধারিত দিনে সিদ্ধান্ত নিন।
সূত্র: গার্ডিয়ান