‘অগণিত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছোট্ট হলেও তাঁর কিছুটা অংশ তিনি রেখে গেছেন’

জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল। তাঁর বহু শিক্ষার্থী দেশে-বিদেশে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন। আজ এই বরেণ্য মানুষটির মৃত্যুবার্ষিকী। ২০২০ সালে বাবা দিবস উপলক্ষে জামিলুর রেজা চৌধুরীকে নিয়ে লিখেছিলেন তাঁর মেয়ে কারিশমা ফারহীন চৌধুরী। আজ তাঁর স্মরণে লেখাটি আবার প্রকাশ করা হলো।

বাবা জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে একটি চমৎকার শৈশব কেটেছে তাঁর দুই সন্তান কারিশমা ফারহীন চৌধুরী ও কাশিফ রেজা চৌধুরীর
বাবা জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে একটি চমৎকার শৈশব কেটেছে তাঁর দুই সন্তান কারিশমা ফারহীন চৌধুরী ও কাশিফ রেজা চৌধুরীর

ছোটবেলা থেকেই আমি আমার বাবা জামিলুর রেজা চৌধুরীকে অত্যন্ত ব্যস্ত দেখে এসেছি। ১৯৮০–এর দশকে আমি এবং আমার ভাই যখন স্কুলে পড়ি, লোডশেডিংয়ের কারণে ঢাকায় প্রতি রাতে নিয়মিত ১ থেকে ২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না। এই সময়টা আমাদের খুব প্রিয় ছিল, কারণ আইপিএস বা জেনারেটর না থাকায় সেই সময় আমার বাবা অন্য কোনো কাজ করতে পারতেন না এবং বারান্দায় বসে আমাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে গল্প করতেন। কখনো তা হতো বিজ্ঞানবিষয়ক, কখনো ইতিহাসবিষয়ক, কখনো তাঁর ছেলেবেলার ঘটনা, আবার কখনো কাল্পনিক চরিত্র ‘ইমনি-রুমনির’ ভ্রমণকাহিনি। শেষেরটি ছিল আমাদের সবচেয়ে প্রিয়। কারণ ইমনি-রুমনির বদৌলতে মানসচক্ষে পৃথিবীর সব দেশ দেখা হয়ে যেত।

তাঁর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি ছোট-বড় সবার সঙ্গে সমান আগ্রহ নিয়ে গল্প করতেন। ছোটরা তাঁকে কোনো প্রশ্ন করলে তিনি সহজ করে বলতে গিয়ে অশুদ্ধ উত্তর দিতেন না। তাঁর ভাষ্য ছিল, সঠিক অথচ জটিল উত্তরটি শিশুরা তাৎক্ষণিকভাবে না বুঝলেও তাদের মতো করে জরুরি অংশটি আত্মস্থ করবে এবং পরে কোনো একসময় এটি তাদের পুরো বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করবে। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের যৌথ পরিবারের সব শিশুকেই অনুসন্ধিৎসু হয়ে বড় হতে সাহায্য করেছে। তিনি পরিবারের সব দুষ্টু ও চঞ্চল বাচ্চাদের কাছে বিশেষভাবে প্রিয় ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘দুষ্টু বাচ্চা মানে বুদ্ধিমান বাচ্চা।’ আমি, আমার ভাই ও পরে আমার ছেলে তাঁর এই ‘দুষ্টুমি করার অনুমতির’ পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে একটি আনন্দময় শৈশব উপভোগ করেছি।

আমাকে ও আমার ভাইকে আমার বাবা (ও মা) পুরোপুরি ‘জেন্ডার ইকুয়াল’ দৃষ্টিভঙ্গিতে বড় করেছেন। আমাদের দুজনের খেলনাই ছিল লেগো, মেকানো সেট, জিগসো পাজল, মাস্টারমাইন্ড, স্ক্র্যাবল ও অন্যান্য ধাঁধা বা শব্দ মেলানোর খেলা। সে সময় এটা খুব স্বাভাবিক মনে হলেও পরে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নিয়ে জেনেছি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিতে মেয়েদের অনাগ্রহের পেছনে শৈশবের মেয়েলি খেলনার প্রভাব আছে। বুঝতে পেরেছি, আমি কতটা সৌভাগ্যবান শিশু ছিলাম। এর অনাকাঙ্ক্ষিত ফল ছিল, ২০০২ সালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) পিএইচডি করার লক্ষ্যে একা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আবিষ্কার করা, আমি মাছ-মাংস কিছুই রাঁধতে পারি না!

বাবার সঙ্গে লেখক

স্কুলজীবনে আমার বন্ধুবান্ধবেরা গল্প করত, তাদের বাবারা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার চেষ্টা করতে বলতেন। আমি শুনে অবাক হতাম, কারণ আমার বাবা বলতেন তার উল্টোটা। তার জীবনদর্শন ছিল, ‘লাইফ ইজ আ ম্যারাথন, নট আ স্প্রিন্ট।’ তাই সারাক্ষণ পড়ালেখা করা বা স্কুলে প্রথম হওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বিভিন্ন বিষয়ে কৌতূহলী থাকা এবং শেখার যাত্রাটা উপভোগ করা।

বাবার সঙ্গে আমার শৈশবের ‘কম প্রিয়’ একটা স্মৃতি হচ্ছে তাঁর কাছে অঙ্ক শেখা। গণিতে গতানুগতিক মানদণ্ডে ভালো হওয়া সত্ত্বেও এ ব্যাপারে আমার বাবাকে খুশি করতে পারা ছিল দুরূহ কাজ। ৮-১০ বছর বয়সেই আর্মস্ট্রং নাম্বার, হেক্সাগোনাল নাম্বার, ফিবোনাচি সিরিজের মতো জটিল বিষয় এবং নানা রকম মানসাঙ্ক শিখিয়ে তিনি আমার শৈশব জর্জরিত করেন। পরে তাঁর ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় একরকম রেহাই পেয়েছিলাম!

ছেলেবেলার আরেকটা প্রিয় স্মৃতি হলো, বাবা শহরের বাইরে কোথাও গেলে ফেরার পরই সবিস্তারে তাঁর ভ্রমণের গল্প শোনাতেন। ছোটবেলায় আমার ধারণা ছিল, ভালোমতো পড়াশোনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারলেই আমি তাঁর মতো দেশ-বিদেশের নানা শহর ঘুরতে পারব। পরে আমি যদিও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি, তার আগেই আমার বাবা বুয়েট থেকে অবসর গ্রহণ করায় সহকর্মী হিসেবে আমি তাঁকে পাইনি। তবে পরে আমি ভিনদেশে যখন যেই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ালেখা বা কাজ করেছি, বাবা সব সময় আগ্রহ নিয়ে জানতে চেয়েছেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো কোনো দিক বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োগ করা যায় কি না। লক্ষ করেছি, শুধু আমি না; তাঁর যত ছাত্রছাত্রী বিদেশে অধ্যাপনা করছেন, সবার কাছেই তিনি কারিগরি ও বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনাবিষয়ক নতুন কিছু শিখতে আগ্রহী ছিলেন।

তাঁর জীবনের শেষ কয়েক দিনে আমার, আমার ভাই এবং পরিচিত অনেকের সঙ্গেই তাঁর আলোচনার বিষয় ছিল ‘অনলাইন এডুকেশন’। বিশেষত, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কী কী পদক্ষেপ নিলে সবার জন্য অনলাইন এডুকেশন নিশ্চিত করা যায়, (যেন করোনাকালে লকডাউনে বাংলাদেশের শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজন্ম লেখাপড়ায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে পিছিয়ে না পড়ে) এ ব্যাপারে তিনি ভাবছিলেন।

আমি প্রতিনিয়তই, এবং বিশেষ করে কয়েক বছর ধরে, আমার বাবার অতিরিক্ত কাজ করা নিয়ে অনুযোগ করতাম। কারণ, আমার মনে হতো তাঁর পর্যাপ্ত বিশ্রাম হচ্ছে না। কিন্তু ক্রমে বুঝতে পারি এবং মেনে নিই যে গণিত অলিম্পিয়াড, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা—এগুলোই ৯টা-৫টা গতানুগতিক কাজের বাইরে তাঁর চালিকা শক্তি। বস্তুত, বাংলাদেশের শিশু, কিশোর ও তরুণেরা ছিল তাঁর জীবনীশক্তির অন্যতম উৎস।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, যদিও আমার বাবা সশরীরে নেই, তবে তাঁর অগণিত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তাঁর ছোট্ট হলেও কিছুটা অংশ তিনি রেখে গেছেন। তাঁর অপ্রত্যাশিত প্রয়াণের এই দুঃসময়ে, বাবাহীন বাবা দিবসে, এটাই আমার একমাত্র সান্ত্বনা।

লেখক: অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব লিডস, যুক্তরাজ্য