সব বাঘের মেজাজ একরকম না
সব বাঘের মেজাজ একরকম না

খবরদার, শের হ্যায়!

শিকারি, নিসর্গী ও লেখক হিসেবে জিম করবেটের খ্যাতি জগৎজোড়া। জন্মেছিলেন ১৮৭৫ সালে ভারতের কুমায়ুন অঞ্চলের নৈনিতাল শহরে। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশ মুলুক থেকে এসে থিতু হয়েছিলেন ভারতে। পাহাড় ও অরণ্যঘেরা পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন করবেট। অসহায় মানুষের প্রাণ বাঁচাতে শিকার করেছেন অনেক নরখাদক বাঘ। অচিরেই ঝানু শিকারি হিসেবে ভারতবর্ষে তাঁর নাম রটে যায়। আর শিকারকাহিনির দৌলতে পরে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। কুমায়ুনের মানুষখেকো, রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতা, জাঙ্গল লোর, মন্দিরের বাঘ এবং কুমায়ুনের আরও মানুষখেকো তাঁর বিখ্যাত সব বই। শিকারি হলেও প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাণিজগতের জন্য করবেটের ছিল বিপুল ভালোবাসা। তাই তো শিকারি পরিচয়ের পাশাপাশি পরিবেশবাদী হিসেবেও তিনি সমান গুরুত্বপূর্ণ। ২৫ জুলাই ছিল জিম করবেটের জন্মদিন। আর জানেন তো, প্রতিবছর ২৯ জুলাই পালিত হয় আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস। প্রাণিকুলে তেজ, সৌন্দর্য আর সাহসে বাঘ অনন্য। তাই আজ পড়ুন জিম করবেটের মন্দিরের বাঘ এবং কুমায়ুনের আরও মানুষখেকো বইয়ের ‘তল্লাদেশের মানুষখেকো বাঘ’ অধ্যায় থেকে দুটি নির্বাচিত অংশ।

বাঘ নিয়ে আমার আগ্রহ দীর্ঘদিনের, প্রায় যত দূর আমার স্মৃতি যায়, তত দিনের। আর এমন একটা অঞ্চলে আমার জীবন কেটেছে, যেখানে বাঘও ছিল প্রচুর, তাদের লক্ষ করার সুযোগও ছিল যথেষ্ট। যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন আমার একমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষাই ছিল একটা বাঘ দেখব। ব্যস, আর কিছুরই দরকার নেই। পরে বাঘ মারার ইচ্ছা হলো। তারও পরে ইচ্ছা হলো বাঘের ছবি তুলব। কালক্রমে আমার এই তিনটি ইচ্ছাই পূরণ হয়েছিল। বাঘ সম্পর্কে যেটুকু জানি, সেটুকু জানার সুযোগ এই ছবি তোলার সময়েই হয়েছিল।

বাঘ–অধ্যুষিত সব জঙ্গলে অবাধে ঘোরার প্রচুর সুযোগ আমি পেয়েছি। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, একবার একনাগাড়ে সাড়ে চার মাস ধরে লক্ষ করে বাঘের স্বভাব সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছিলাম। বাঘ কখনো শিকারের পিছু ধাওয়া করে না, হয় সে শিকারের জন্য ওত পেতে থাকে, না হয় গোপনে তাকে অনুসরণ করে। উভয় ক্ষেত্রেই সে হয় লাফ দিয়ে শিকারের ঘাড়ে পড়ে, না হয় কয়েক গজ দৌড়ে তারপর লাফ দেয়।

জিম করবেট (২৫ জুলাই ১৮৭৫—১৯ এপ্রিল ১৯৫৫)

কোনো জানোয়ার যদি বাঘের লাফ দেওয়ার দূরত্বটুকু এড়িয়ে চলতে পারে, বাঘকে যদি ঠিকমতো অনুসরণ করতে না দেয় আর দৃশ্য, গন্ধ, শব্দ থেকে বিপদের আভাস বুঝে নিতে পারে, তাহলে তার আর পরিণত বয়স পর্যন্ত বাঁচতে কোনো বাধা নেই। জানোয়ারদের যে তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তি, মানুষের তা নেই; কারণ, সভ্যতা অনেক কিছুর মতো মানুষের এই ক্ষমতাও কেড়ে নিয়েছে। তাই মানুষ যখন কোনো নরখাদক প্রাণীর কবল থেকে বাঁচার চেষ্টা করে, তখন নিরাপত্তার জন্য তাকে সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হয় দৃষ্টিশক্তির ওপর।

২.

সব বাঘের মেজাজ একরকম না। তাই আহত কোনো বাঘের কাছে কেউ গেলে সে কী করবে, বলা কঠিন। আহত বাঘ কত দিন বিপজ্জনক থাকে, অর্থাৎ বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটালে কত দিন পর্যন্ত আক্রমণ করতে পারে, বলা মুশকিল।

একটা বাঘকে দেখেছিলাম, পালাতে গিয়ে তার পেছনের পায়ের ইঞ্চিখানেক কেটে যায়। এই আঘাত পাওয়ার ৫ মিনিট পর প্রায় ১০০ গজ দূরে থেকে সে প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ করে। আরও একটা বাঘ দেখেছিলাম বহু ঘণ্টা ধরে যে চোয়ালের প্রচণ্ড ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিল, তারপরও কিন্তু কয়েক ফুটের মধ্যে মানুষ পেয়েও আক্রমণের চেষ্টা করেনি।

বাঘেরা সাধারণত বেশ ঠান্ডা মেজাজের হয়

কিন্তু আহত নরখাদক বাঘেদের কথা সম্পূর্ণ আলাদা। কাছাকাছি কেউ গেলে বাঘটি তাকে আক্রমণ করবে কি না, বলা মুশকিল। তা ছাড়া জখমটা যখন শরীরের ভেতরের নয়, তখনও খাদ্য সংগ্রহের জন্য বাঘ আক্রমণ করতে পারে। আহত বা নরখাদক না হলে বাঘেরা সাধারণত বেশ ঠান্ডা মেজাজের হয়। তা যদি না হতো তাহলে যেসব বনে বাঘ আছে, সেখানে হাজার হাজার লোকের কাজকর্ম করা সম্ভব হতো না। আর আমার মতো লোকের পক্ষেও বছরের পর বছর জঙ্গলে জঙ্গলে হেঁটে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব হতো না।

মাঝেমধ্যে কোনো বাঘ তার বাচ্চার খুব কাছাকাছি আসা বা যে মড়িটা (বাঘের শিকার করা মৃত প্রাণী) সে আগলে রেখেছে, তার আশপাশে যাওয়া পছন্দ করে না। একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ করে প্রথমে সে তার বিরক্তি প্রকাশ করে। তাতে যদি কাজ না দেয়, তখন সে একটু ছুটে এসে প্রচণ্ড গর্জন করে। এ গর্জনেও যদি কাজ না হয়, তাহলে যে ভয়াবহ কাণ্ডটি ঘটে, তার দায় সম্পূর্ণ আগন্তুকের।

৩.

কয়েক বছর আগের যে অভিজ্ঞতার কথা এখন বলছি, তাতেই প্রমাণিত হয় বাঘেরা কত শরিফ মেজাজের জীব। আমাদের কালাধুঙ্গির বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে বোর নদীতে একদিন আমার বোন ম্যাগি আর আমি মাছ ধরছিলাম। ছোট ছোট দুটি মহাশোল ধরে একটা পাথরের ওপরে বসে ছিলাম। এমন সময় হাতির পিঠে চড়ে সেখানে এসে উপস্থিত জিওফ হকিন্স (পরে যিনি উত্তর প্রদেশের বনরক্ষক হয়েছিলেন)। বাড়িতে তাঁর কজন বন্ধুর আসার কথা। মাংস কম পড়ে যাওয়ায় রাইফেলটি নিয়ে কিছু বনময়ূরীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছেন। আমার মাছ ধরা

হয়ে গিয়েছিল, তাই উনি বলতেই তাঁর সঙ্গে শিকারে বেরিয়ে পড়লাম।

হাতিতে চড়ে নদীটা পেরিয়ে গেলাম। মাহুতকে ময়ূর পাওয়া যায়, এমন একটা জঙ্গলের দিকে যেতে বললাম। ছোট ছোট ঘাস আর বুনোকুলের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম। এমন সময় দেখলাম, একটা গাছের তলে একটা চিত্রা হরিণ মরে পড়ে আছে। চিত্রাটা কীভাবে মরেছে, দেখার জন্য হাতিটাকে থামিয়ে নেমে গেলাম।

বয়স্ক মাদী চিত্রাটা মারা গেছে প্রায় ৪০ ঘণ্টা। শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন না দেখে ভাবলাম, বোধ হয় সাপের কামড়ে মারা গেছে। হাতিতে ওঠার জন্য পেছনে ফিরে দেখি একটা পাতার ওপর এক ফোঁটা তাজা রক্ত।

আহত বাঘ কত দিন বিপজ্জনক থাকে, অর্থাৎ বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটালে কত দিন পর্যন্ত আক্রমণ করতে পারে, বলা মুশকিল

রক্তের দাগের আকার দেখেই মনে হলো, যে জানোয়ার থেকে রক্তটা ছিটকে পড়েছে, সে মরা চিত্রাটার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। রক্তের ছিটা থেকে জানোয়ারটা যেদিকে গেছে, সেদিকটা আন্দাজ করে দেখি, সেখানেও রক্তের দাগ। হাতিটাকে আমার পিছু পিছু আসতে বলে রক্তের নিশানা ধরে এগিয়ে গেলাম।

ঘাসের ওপর দিয়ে ৬০–৭০ গজ যাওয়ার পর ৫ ফুট উঁচু ঘন একটা ঝোপের সামনে এসে পড়লাম। রক্তের দাগ যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে এসে দুই হাত দিয়ে ঝোপটা ফাঁক করলাম। আমার হাতের ঠিক নিচেই আরেকটা চিত্রা হরিণ পড়ে আছে। একটা বাঘ হরিণটাকে খাচ্ছিল। ঝোপটা সরাতেই বাঘটা আমার দিকে এমনভাবে মুখ তুলে তাকাল, যার অর্থ হচ্ছে, ‘এ তো আচ্ছা জ্বালাতনে পড়া গেল!’

আমিও মনে মনে ওই একই কথা বলছিলাম। এত হকচকিয়ে গিয়েছিলাম যে নড়ার শক্তি পর্যন্ত ছিল না, আমার হৃৎপিণ্ডও খুব সম্ভব থমকে গিয়েছিল, তাই নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম।

বাঘটার এত কাছে ছিলাম যে ইচ্ছা করলেই সে আমার মাথায় ওর থাবাটা বুলিয়ে দিতে পারত। কিন্তু তা না করে বাঘটা কয়েক মুহূর্ত সোজা আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে উঠে দাঁড়াল, ঘুরে অপূর্ব সাবলীল ভঙ্গিতে লাফ দিয়ে পেছনের ঝোপে চলে গেল। আমরা আসার একটু আগে বাঘটা সেই কুল জঙ্গলে হরিণটাকে মেরে মরা চিত্রাটার পাশ দিয়ে এই ঝোপে টেনে এনেছে। আর টেনে আনার সময় রেখে এসেছে রক্তের দাগ। সেই দাগই আমি অনুসরণ করেছিলাম।

হাতির পিঠে যে তিনজন ছিল, তারা বাঘটাকে দেখতে পেল লাফিয়ে জঙ্গলে চলে যাওয়ার সময়! ভয়ে চিৎকার করে উঠল মাহুত, ‘খবরদার, সাহিব! শের হ্যায়!’