কখনো কানে, কখনো গলায় জড়ানো হেডফোন। হাতে শব্দধারণ করার বুম। শরীরে জড়ানো বেল্টের সঙ্গে বুমের রেকর্ডার। কখনো আবার শরীরজুড়েই নানা যন্ত্রাংশ। শুটিংস্পটে এভাবেই শারমিন দোজাকে দেখা যায়। কাজ করতে করতে অনেক সময়ই কানে ভেসে আসে কোনো পুরুষ সহকর্মীর তীর্যক মন্তব্য, ‘এগুলো মেয়েদের কাজ না।’
আসলে ক্যামেরাম্যান, লাইট, সম্পাদনা, শব্দধারণের মতো কারিগরি কাজগুলোয় এখনো নারীকে দেখে অভ্যস্ত নন এখানকার মানুষ। যুগ যুগ ধরে এসব কাজ পুরুষদের করে আসতে দেখছেন তাঁরা। শুরুর দিকে কেউ কেউ আবার মনে করতেন, দু–এক দিন করেই বিদায় নেবেন। মন খারাপ হলেও সেসব কথায় ভেঙে পড়েননি দোজা। সহকর্মীদের নেতিবাচক কথা বরং তাঁকে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস জুগিয়েছে, দিয়েছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ। আট বছর ধরে এভাবেই বুম অপারেটর ও লাইভ সাউন্ড রেকর্ডিস্ট হিসেবে কাজ করে চলেছেন দোজা।
পুরুষশাসিত একটা পেশায় দিনের পর দিন কাজ করে যাওয়ার প্রেরণা কোথায় পান? এমন প্রশ্নে দোজা বলেন, ‘শৈশব থেকে পরিবারই আমাকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে। একসময় ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতাম, আড্ডা দিতাম। মেয়ে হিসেবে নিজেকে গুটিয়ে রাখাকে পছন্দ করতাম না।’
এই সময় তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু যখন কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, শুধু পুরুষই না, মেয়েরাও বিষয়টাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখছে। অনেকেই বলেছে, “তুমি কি এ বিষয়ে মাস্টার্স করেছ যে সাউন্ডের মতো একটা কাজ করছ।” তাদের বলার ভঙ্গিটা এমন, যেন আমার মেধা নেই; আর আমি তুচ্ছ কোনো কাজ করছি, যেটা কোনো শিক্ষিত মানুষ করে না। তখন আমার মন খারাপ হতো। ভাবতাম, নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে কাজ করেই আগাতে হবে।’
শৈশব থেকেই লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন শব্দগুলো ভালো লাগত। চেয়েছিলেন নির্মাতা হবেন, পর্দায় তুলে ধরবেন নারীদের গল্প। সেই পথে পা বাড়িয়ে বুঝতে পারেন সম্পাদনা, সাউন্ডসহ অন্যান্য টেকনিক্যাল কাজও নির্মাতাদের জানা দরকার। সম্পাদনা শিখতে থাকেন। এর মধ্যেই দেখতে পান, দেশের বেশির ভাগ নাটক-সিনেমার সাউন্ড রেকর্ডিংয়ের মান খারাপ, অনেকে এটাকে গুরুত্বও দেয় না। শব্দধারণ শিখতে গিয়ে আস্তে আস্তে কাজটির প্রতি ভালোবাসা জন্মে যায়। এখন নিয়মিতই তিনি অন্যান্য নির্মাতার চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমায় শব্দধারণের কাজ করেন।
সেই অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে বলেন, ‘প্রথমে একটি ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলাম। আমিই ছিলাম নির্মাতা। সেই আমিই যখন সাউন্ড রেকর্ডিস্ট হিসেবে কাজ শিখতে শুরু করি, আগে যাঁরা আমার আন্ডারে কাজ করেছেন, তাঁরাই তখন সাউন্ড নিয়ে কাজ শেখার সময় বলেন, আমার সঙ্গে এক টেবিলে খাবেন না, মিশবেন না, ইগোর জায়গা থেকে মেয়ে হিসেবে আমাকে আলাদাভাবে ট্রিট করতেন। বেশির ভাগ সময়ই শুটিং টিমে আমি একা থাকতাম। খুবই খারাপ লাগত। অনেক বাধা পেরিয়ে আমাকে কাজ শিখতে হয়েছে।’
২০১৫ সালের শেষ দিক থেকে নাহিদ মাসুদের সঙ্গে দোজার কাজ শেখা শুরু। চলচ্চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদের তিনি ছোট ভাই। নাহিদ-দোজা এখন স্বামী–স্ত্রী। দোজা জানান, ঢাকা কিংবা ঢাকার বাইরে শুটিংয়ের জন্য ডাক পড়লেই ছুটে যান। তিনি যে নারী, এটা কখনো মাথার রাখেন না। হাসিনা: আ ডটার’স টেল, সাঁতাও, ভালোবাসা দিবসে মুক্তি পাওয়া ‘ক্লোজ আপ কাছে আসার গল্প’–এ কাজ করে প্রশংসা পেয়েছেন। এ ছাড়া বিদেশি টিমের সঙ্গে তিনটি সিনেমা ও তথ্যচিত্রেও সাউন্ডের কাজ করেছেন। সহকারী হিসেবে বিবিসির উজান গাঙের নাইয়া, সিনেমা বানান, পূর্ণগ্রাস কালসহ বেশ কিছু কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
দোজা বলেন,‘কখনো দেখা যায় নারী হওয়ায় আমাকে টিমে নিতে চায় না। কারণ, টিমে আমি একমাত্র নারী। আলাদা সুযোগ–সুবিধা দরকার হয়। বাজেট বেড়ে যায়। অনেক সময় মনে করেন, নারী আর কতটুকু বুঝবে। হয়তো নারী হিসেবে আমাকে বাদ দেওয়া হলো। তবে অনেক নারী নির্মাতা আবার কমফোর্ট জোনের জন্য আমাকেই খোঁজেন। কারণ, গল্পে এমন কিছু ডায়ালগ আছে, যেটা হয়তো ছেলে থাকলে কোনো অভিনেত্রী বলবেন না।’
সারা শরীরে নানা যন্ত্রপাতি জড়িয়ে কখনো ঢাকার রাস্তায়, কখনো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শুটিং করেন দোজা। এই পোশাক–আশাক নিয়েও প্রায়ই তাঁকে বিব্রতকর কথা শুনতে হয়। দোজা বলেন, ‘নারী হিসেবে সাধারণ কোনো পোশাক পরলেই রাস্তার অনেক পুরুষ শুধু শুধু তাকিয়ে থাকে। এখন ইকুইপমেন্টসহ একজন নারীকে রাস্তায় দেখলে কীভাবে মানুষ তাকায় বোঝেন। তবে এগুলোতে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তারপরও মাঝেমধ্যে বিরক্ত লাগে। কিন্তু পেশার জায়গায় চাই না আমাকে কোনো সহকর্মী বাঁকা কথা বলুক। নিজের মতো করে কাজ করে যেতে চাই। এটাই আমার পেশা।’