ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং এখনকার বহুল আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। অনেকেই ভাবেন, মানুষ আমার কাজগুলো চিনুন, আমাকে চিনতে হবে কেন? কিন্তু ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিংয়ের ধারণা এই চিন্তাধারাকে সমর্থন করে না। আপনার ‘টার্গেট কাস্টমার’রা শুধু আপনার কাজকে নয়, কাজের মাধ্যমে আপনাকেও চিনবে, আপনার সঙ্গেও খুব ভালোভাবে পরিচিত হবে, এটিই ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিংয়ের মূল কথা। এ বিষয়ে অনেক বেস্টসেলার বই লেখা হয়েছে। তবে আজ আমরা কোনো বই নিয়ে আলাপ করব না। আমরা কথা বলব একটি সিনেমা নিয়ে।
হলিউডের ‘দ্য ডেভিল ওয়্যারস প্রাডা’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ২০০৬ সালে। মার্কিন লেখক লরেন ওয়াইসবার্গারের উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে কমেডি ধাঁচের এই সিনেমা পরিচালনা করেছিলেন ডেভিড ফ্র্যাঙ্কেল। কেন্দ্রীয় চরিত্র অ্যান্ডির ভূমিকায় অভিনয় করেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী অ্যান হ্যাথাওয়ে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হচ্ছে অ্যান্ডির অফিসের বস মিরান্ডা। বিখ্যাত অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ অভিনয় করেন এই চরিত্রে। সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার সময় ‘পারসোনাল ব্র্যান্ডিং’ শব্দটি এত বেশি আলোচিত ছিল না। কিন্তু সিনেমাটির কাহিনি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পুরো গল্পটিই আদতে দর্শকের সামনে পারসোনাল ব্র্যান্ডিং বা ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিংয়ের গুরুত্ব খুব চমৎকারভাবে তুলে ধরে।
অফিসে শুধু দক্ষতা আর নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করাই জরুরি নয়, নিজেকে এবং নিজের কাজকে সবার সামনে যথাযথভাবে তুলে ধরাও অনেক বেশি প্রয়োজন। নিজের কাজ এবং নিজেকে তুলে ধরতে ব্যর্থ হলে আপনি শুধু কাজই করে যাবেন; আশানুরূপ বেতন, পদোন্নতি কিছুই পাবেন না। অফিসে ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আমরা দেখতে পাই ‘দ্য ডেভিল ওয়্যারস প্রাডা’ সিনেমার অ্যান্ডির জীবন থেকে। একজন সাদাসিধে সহকারী থেকে ধাপে ধাপে সে হয়ে ওঠে একজন আত্মবিশ্বাসী এবং দক্ষ পেশাজীবী। এই পুরো প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তার ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং। নিজেকে একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ড হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন। ক্রমাগত বিভিন্ন বিষয়ে নিজের দক্ষতা বাড়াতে হবে। নেটওয়ার্কিংয়ের বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করাও প্রয়োজন। সর্বোপরি আপনার করা কাজগুলোর মান হতে হবে অসাধারণ। এতে শুধু যে অফিসে আপনার সুনাম বাড়বে, তা-ই নয়, ভালো ক্যারিয়ার গড়ার পথ সৃষ্টি হবে, খুলে যাবে উন্নতির নতুন দুয়ার।
আজকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজের খুঁটি শক্ত করা এবং উন্নতির পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নেটওয়ার্কিংয়ের ক্ষেত্রে কৌশলী হওয়া প্রয়োজন। পরিচিতি বাড়ানোর মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য হারে আপনার ক্যারিয়ারের উন্নতি বাড়ানো সম্ভব। কাজের সুবাদে যত বেশি মানুষের সঙ্গে পরিচিত হবেন, নিজের ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে আপনি তত বেশি ধারণা লাভ করবেন, তত বেশি সুযোগ-সুবিধা আপনার নাগালে আসবে। নিজের নেটওয়ার্কিং দক্ষতা আরও কার্যকর এবং উন্নত করা; আপনার কাজের ক্ষেত্রে যাঁরা প্রভাবশালী, তাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং যোগাযোগ রক্ষা করা আপনাকে সাফল্যের পথে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে দিতে পারে। অফিসের পরিবেশ এবং ‘পলিটিকস’ বুঝতে পারলে আপনি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কর্মক্ষেত্রে আরও ভালোভাবে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন। নিজের মেন্টর এবং সিনিয়রদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখলে, তাঁদের কাছ থেকে আপনি অনেক মূল্যবান দিকনির্দেশনা এবং অনেক কিছু শেখার সুযোগ পাবেন। তাই ভালোভাবে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং সম্পর্কের যত্ন নেওয়া ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উন্নতির জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
নীতি ও সততা ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাৎক্ষণিক ফল পাওয়া না গেলেও নিজের কাছে সৎ থাকা, সঠিক পথ বেছে নেওয়া সব সময়ই জরুরি। যেসব সমাধানের কারণে সাময়িক তৃপ্তি আসে, সেসব অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য এবং সুনামের ক্ষতি করে। কর্মজীবনে যতই ঝড়ঝাপটা আসুক না কেন, সব পরিস্থিতিতে সৎ থাকলে আপনার ব্যক্তিগত মূল্যবোধ বজায় থাকবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনি প্রকৃত সাফল্য এবং সুখ্যাতি অর্জন করবেন।
যাঁদের আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বেশি, তাঁরা অন্যদের তুলনায় দ্রুত জটিল পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার কারণে মানুষ নিজের আবেগগুলো চিনতে এবং নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে; অন্যের ওপর আবেগগুলোর কী প্রভাব পড়তে পারে, সে সম্পর্কে সচেতন থাকে। করপোরেট পরিবেশে এটি অতিপ্রয়োজনীয় একটি গুণ। ‘দ্য ডেভিল ওয়্যারস প্রাডা’ সিনেমায় অ্যান্ডি তার বস মিরান্ডার চাহিদা অনুযায়ী আচরণ এবং কর্মস্থলের ভীষণ চাপেও নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে। দমবন্ধ পরিবেশেও নিজেকে স্থির রাখতে এবং পেশাদার আচরণ করতে সক্ষম হয় সে। পাশাপাশি সহমর্মী হয়ে ওঠে অ্যান্ডি, ধীরে ধীরে সহকর্মীদের বুঝতে এবং তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে শেখে। অ্যান্ডির ক্রমবর্ধমান ইমোশনাল ইন্টেনিজেন্স তাকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত মোকাবিলা করতে এবং আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রে আরও বিচক্ষণ হতে সাহায্য করে। এই সিনেমা ফ্যাশনের মতো একটি প্রতিযোগিতামূলক ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার ক্ষেত্রে আবেগ নিয়ন্ত্রণ, সম্পর্ক তৈরি এবং বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিত্বের মানুষ এবং চ্যালেঞ্জের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর গুরুত্ব তুলে ধরেছে।
যেকোনো প্রকল্প বা কাজের ক্ষেত্রে নিজের প্রত্যাশাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা গুরুত্বপূর্ণ। ‘দ্য ডেভিল ওয়্যারস প্রাডা’ সিনেমার মিরান্ডা প্রিস্টলি চরিত্রটিতে আমরা দেখতে পাই কীভাবে তিনি কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। করপোরেট পরিমণ্ডলে কেউ এমন করতে চাইলে তাঁকে প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে, দলের প্রত্যেক সদস্য কাজটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন। কাজটি করার সময় কোন কোন ব্যাপারকে প্রাধান্য দিতে হবে, কাজটি কখন শেষ করতে হবে, এসব ব্যাপারেও প্রত্যেক কর্মীকে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। দলের জন্য উচ্চাভিলাষী কিন্তু বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন। প্রতিটি ব্যক্তি যদি তাঁর নিজের ভূমিকা এবং দায়িত্ব স্পষ্টভাবে জানেন, তাহলে জবাবদিহির সুযোগ বাড়ে, ভুল–বোঝাবুঝির আশঙ্কা কমে আসে।
ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এতে সময় নষ্ট হয়, এই অভিযোগ আমরা প্রায়ই করি। অথচ বুদ্ধি করে ব্যবহার করতে পারলে এটাই হতে পারে আপনার ব্র্যান্ডিংয়ের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। কিছু কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুধু পেশাগত কাজে ব্যবহারের জন্যই তৈরি। যেমন লিংকডইন। আপনি এসব ওয়েবসাইটে নিজের পড়াশোনা, চাকরিবাকরি, প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা–সংক্রান্ত সব তথ্য সুন্দর এবং সঠিকভাবে তুলে ধরুন। শুধু সহকর্মীদের সঙ্গেই যুক্ত হয়ে বসে থাকবেন না, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে আপনার মতো যেসব পেশাজীবী আছেন, তাঁদের সঙ্গে পরিচিত হোন। আপনার পেশাগত জীবনের ছোট–বড় অর্জনগুলো প্রোফাইলে নিয়মিত শেয়ার করুন। হোক সেটা পদোন্নতি কিংবা ছোট একটা ওয়ার্কশপে অংশ নেওয়ার খবর বা ছবি। কর্মজীবনে আপনি যেসব বিষয়ে দক্ষ, সেসব বিষয়ে আর্টিকেল, ব্লগ, ইনফোগ্রাফিকস, টিউটোরিয়াল বা ছোট ছোট টিপসও শেয়ার করতে পারেন।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া