পড়তে হবে খুব ভোরে, ছোটবেলা থেকে গুরুজনদের কাছ থেকে বরাবর এই কথাই শুনে আসছি। ভোরের শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশে পড়ালেখাটা নাকি মাথায় ‘ঢোকে’ ঠিকঠাক। বাস্তবিকই কি পড়ালেখার এমন কোনো নিয়ম আছে? কেউ কেউ তো দেখি উল্টো কথাও বলেন। বলেন রাত যত গভীর হয়, তত তাঁদের পড়ায় মন বসে বেশি।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত শেখার জন্য সর্বোত্তম। দিনের মধ্যভাগ থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত সময়টাকে যৌক্তিক চিন্তাধারা কিংবা সমস্যা সমাধানের জন্য সবচেয়ে ভালো বলে মনে করছেন একদল গবেষক। সাম্প্রতিক সময়ের একটি গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতেই তাঁদের এমন সিদ্ধান্ত।
গবেষণার অতসব কচকচানির মধ্যে না গিয়ে সময়ের সঙ্গে পড়ালেখার সম্পর্কটাকে আরও সহজভাবে ব্যাখ্যা করলেন ঢাকার স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের নিউরোমেডিসিন বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. রমা বিশ্বাস। জানালেন, পড়ালেখার জন্য ঠিকঠাক ঘুম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই ৭-৮ ঘণ্টা প্রশান্তির ঘুম হতেই হবে। ঘুম আমাদের মস্তিষ্ককে সতেজ করে। ঘুম থেকে ওঠার পর প্রাত্যহিক কাজকর্ম সেরে কেউ যখন পড়তে বসেন বা কোনো বিষয় শেখার চেষ্টা করেন, মস্তিষ্ক তখন সেটাকে সহজভাবে গ্রহণ করে। তবে মনঃসংযোগের ব্যাঘাত ঘটলে আর তা সম্ভব হয় না। এই যেমন আশপাশের আওয়াজ কিংবা মুঠোফোনই ঘটাতে পারে বিঘ্ন। সঠিকভাবে পড়ালেখার জন্য সুস্থ জীবনচর্চা যেমন সুষম খাদ্যাভ্যাস, খেলাধুলা, দৌড়ঝাঁপ, ছোটাছুটি—এসবই আবশ্যক, জানালেন ডা. রমা।
জীবন যখন যেমন
দিনের বেলায়, ক্লাস আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়েন উর্মিতা দত্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জারি বিভাগের এই এমএস শিক্ষার্থীর অর্জনের তালিকাটা বেশ বড়। ২০০৯-১০ সেশনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় দুই জায়গাতেই পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ক্লাসের পর বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করে রাত জেগে পড়তেন তখন। স্কুলজীবনে দিবা শাখায় ছিলেন বলে তখনো রাতে পড়তেন। তবে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে প্রভাতি শাখায় থাকায় পড়ালেখা করতেন বিকেলে বা সন্ধ্যায়। এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পথে প্রতিটি পেশাগত পরীক্ষাতেই প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন উর্মিতা। ৩৭তম বিসিএস পরীক্ষায় চিকিৎসা ক্যাডারেও প্রথম হন তিনি। সরকারি চাকরিতে পদায়নের আগে অবৈতনিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ছিলেন।
তখন কাজের ফাঁকেই স্নাতকোত্তরের জন্য পড়তেন। সকালে উঠেও পড়তেন। এভাবে পড়ালেখা করেই জেনারেল সার্জারিতে এফসিপিএস প্রথম পর্ব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, এমএস কোর্সেও সুযোগ পান। উর্মিতা যখন যেভাবে যতটুকু সুযোগ পান, কাজে লাগান।
রাতের নীরবতায় অখণ্ড মনোযোগ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আনাস ফেরদৌস পড়ালেখার জন্য পছন্দ করেন রাতের শান্ত পরিবেশ। আলাদা ঘর, সাজানো-গোছানো টেবিলে পড়ালেখা ভালো হয় তাঁর। টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে নেন পড়ার সময়, আলো পড়ে বইয়ের পাতায়। এভাবে মনোযোগ স্থির রাখতে সুবিধা হয় বলে জানান এই তরুণ। দিনে নানা ব্যস্ততা। তবে একফাঁকে ঘুমিয়েও নেন। পড়তে বসেন রাত আটটা-নয়টায়। রাত দুইটার মধ্যে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলেন, তবে কখনো খারাপ লাগলে পড়া শেষ করার আগেও বিশ্রামে যান।
সু-অভ্যাসের চর্চা
সকাল থেকে ক্লাস। এরপর ল্যাব। বাসায় ফিরতেই বিকেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জয়িতা চক্রবর্ত্তীর পড়ালেখার জন্য রাতের সময়টাই হাতে থাকে। স্কুলজীবনে পড়েছেন প্রভাতি শাখায়। তখন কিন্তু দুপুরবেলাও পড়তেন। কলেজে ওঠার পর থেকেই নিজের পড়ার জন্য রাত ছাড়া আর সময় মিলছে না। বিশ্ববিদ্যালয়পর্বে রোজ সমানভাবে না পড়লেও কিন্তু পড়ার অভ্যাসটা ধরে রাখেন তিনি।
পাঠ্যবই, গবেষণাপত্র, গল্পের বই—যেটিই হোক, রোজ অন্তত দুই ঘণ্টা ‘পড়া’র জন্যই বরাদ্দ।
নিজের পড়া, সবার পড়া
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী প্রজ্ঞা রহমান হলে থাকেন। গণরুমের আলো নিভে যায় রাত ১২টায়। পড়তে হলে নির্ধারিত ঘরে যেতে হয়। প্রজ্ঞার রাতে পড়ার অভ্যাস। গণরুম থেকে পড়ার ঘরে বারবার বইপত্র বহন করতে অসুবিধা হয় বলে সপ্তাহান্তে ঢাকার বাসায় গিয়ে পড়েন। পরীক্ষার আগে যেকোনো এক বন্ধুর বাসায় সবাই হাজির হন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, পড়ালেখা আর একাডেমিক আলোচনা।
দিনে কিংবা রাতে পড়া
একাডেমিক কারণে দিনের অধিকাংশ সময় ঘরের বাইরেই কাটে শিক্ষার্থীদের। শেখার প্রক্রিয়া চলমান সেখানেই। যাঁরা একটু তাড়াতাড়ি ঘুমান, তাঁরা ভোরে উঠে প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্ম সেরে পড়ালেখার জন্য কিছুটা সময় পান। তাঁদের আবার রাত জেগে তেমন পড়া হয় না। আবার সবার ক্ষেত্রেই রাত বাড়লে ক্লান্তিও বাড়ে। ডা. রমা বিশ্বাস তাই বলছিলেন, রাতের একেবারে শেষভাগে পড়ালেখার কার্যকারিতা কম।
ভালোবেসে পড়া
কোনো দুপুরে তোত্তোচান আর তার ক্লাসের অন্য শিশুরা হেঁটে হেঁটে নদীর পার, শর্ষেখেত আর স্থানীয় মন্দির এলাকায় ঘুরে ঘুরে শিখে বিজ্ঞান আর ইতিহাস। জাপানি লেখক তেৎসুকো কুরোয়ানাগির তোত্তোচান বইতে এমনটাই বলা আছে। পড়ালেখা তো হওয়া উচিত এমনই আনন্দময়। কেউ পড়ার সময় পছন্দের গান বাজান মৃদু শব্দে, কেউ নিজে একটু জোরে শব্দ করে পড়েন। কেউ চলন্ত গণপরিবহনেও পড়তে পারেন। বুঝে পড়লে পড়তে খুব বেশি সময়ও লাগে না। পরীক্ষার আগে পড়া ভালো হয় ঠিকই, তবে সব পড়া সেই এক রাতের জন্য জমিয়ে রাখা ঠিক নয়। আগেই স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করে একটা ভিত গড়ে নেওয়া প্রয়োজন। তবে ভালো লাগার জন্য লেখাপড়ার বিষয়টাও হওয়া চাই পছন্দসই। জবরদস্তি পড়ালেখা খুব ভালো ফল বয়ে আনে না।